Saturday, June 2, 2018

স্মরণ : ব্যাংকার ও শিক্ষাবিদ আবু মুহাম্মদ

স্মরণ : ব্যাংকার ও শিক্ষাবিদ আবু মুহাম্মদ
আলী ফোরকান
জন্ম  : ১৯৩৪ সালে ৪ আগস্ট
মৃত্য: ২০১৭ সালে ০২জুন
আবু মুহাম্মদ। ১৯৩৪ সালে ৪ঠা আগস্টে রাউজান উপজেলার ছত্রপাড়া গ্রামে আকবর বাড়ির এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আব্দুল লতিফ ও মাতা মাজেদা খাতুন। তিনি ছিলেন একজন গীতিকার, সাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক। পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান। মাত্র তিন বছর বয়সেই তাঁর পিতাকে হারান।
 রাউজান আর.আর.এস.সি হাই স্কুল হতে এস.এস.সি পাস করেন। মেট্রিক পরীক্ষায় ভালো ফলাফল অর্জন করায় তৎকালীন সরকারের পক্ষ হতে স্বর্ণপদক লাভ করেন। চট্টগ্রাম সরকারী কমার্স কলেজ হতে মেধা তালিকায় আই.কম ও বি.কম. পাস করেন। ১৯৫৫ সনে তদানীন্তÍন কেন্দ্রীয় সরকারের ‘সাপ্লাই এন্ড ডেভেলপ্মেন্ড’ বিভাগে যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবনে প্রবেশ। ১৯৫৮ সালের শেষ দিকে তদানীন্তন স্টেট্ ব্যাংক অব পাকিস্তানে যোগদান করেন। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বাংলাদেশ ব্যাংকে একই পদে অভিষিক্ত হন। অতি কর্মদক্ষতার কারণে সরকার তাঁকে ১৯৮৮ সালে পুরস্কার প্রদান করেন। পরবর্তীতে তিনি ১৯৯৪ সালের মার্চ শেষে বাংলাদেশ ব্যাংক হতে অবসর নেন। কর্মজীবনে প্রায় একযুগ ধরে (১৯৮০-১৯৯১) এদেশের প্রথম সফল সুদমুক্ত সমবায় ‘চক্রেসো’ গড়ার কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। ০২জুন, জুমু’ আ’বার রাত ১১.৫৫ মিনিটে ২০১৭ সালে শেষ নিঃশ^াস ত্যাগ করেন। মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। 

Friday, June 1, 2018

স্মরণ :মাস্টার আবদুস সোবহান চৌধুরী

স্মরণ :মাস্টার আবদুস সোবহান চৌধুরী
জন্ম : ১৯৩৮ সালের ১ জানুয়ারি
 মৃত্যু : ২০০৯ সালের ১ জুন
আলী ফোরকান
মাস্টার আবদুস সোবহান চৌধুরী। তিনি প্রয়াত হয়েছেন ২০০৯ সালের ১ জুন।১৯৩৮ সালের ১ জানুয়ারি চট্টগ্রামের বোয়ালিয়া গ্রামের ঐতিহ্যবাহী দোভাষ পরিবারে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। ১৯৪২ সালে শিশু বয়সে তিনি পিতাকে হারান। মা’র অনুপ্রেরণায় নিজ গ্রামের বোয়ালিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ালেখা শুরু করেন। পঞ্চম শ্রেণীর বৃত্তি পরীক্ষায় প্রথম স্থান লাভ করে শিশুকালেই মেধার স্বাক্ষর রাখেন। পরবর্তীকালে ভর্তি হন বটতলী এস.এম.আউলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে। ১৯৪৭ সালে উক্ত বিদ্যালয় হতে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে বৃত্তি লাভ করেন। সেখান থেকে তিনি উচ্চ শিক্ষা লাভে চলে আসেন চট্টগ্রাম সরকারি মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ে। পারিবারিক ও সামাজিক অসহযোগিতার কারণে অর্থাভাবে তিনি এক পর্যায়ে পড়ালেখা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।
চলে আসেন বাড়িতে, ১৯৪৮ সাল থেকে জড়িয়ে পড়েন পারিবারিক চাষাবাদ ও ছোটখাট ব্যবসা বাণিজ্যে। তাতে তিনি বুঝতে পারেন পড়ালেখা ছাড়া জীবনে উন্নতি করা কিছুতেই সম্ভব নয়। অতঃপর ১৯৫১ সালে পুনরায় চট্টগ্রাম কাজেম আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে পড়ালেখা শুরু করেন। উক্ত স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক আবদুর রাজ্জাক, সহকারী প্রধান শিক্ষক মোজাম্মেল হক সাহেবের সুনজরে মেধাবী ছাত্র আবদুস সোবহান চৌধুরী নবম ও দশম শ্রেণীতে বিনা বেতনে অধ্যয়নের সুযোগ পান। বিদ্যালয়ের সাহিত্যসেবি শিক্ষক আয়ুব খানের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি ঝুঁকে পড়েন সাহিত্য সাধনায়। সেই ছাত্রাবস্থাতেই তিনি একাধিক ছোট গল্প, নাটক, প্রবন্ধ রচনা করেন, তা পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হলে তাঁর সুনাম ও মেধার বিকাশ ফুটে ওঠে। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন চলাকালে তিনি সরাসরি যুক্ত হয়ে পড়েন ভাষা আন্দোলনে। এক পর্যায়ে ভাষা সৈনিক মাহবুবুল আলম চৌধুরীর সংম্পর্শে এসে শহরের বিভিন্ন স্থানে মিছিল মিটিং এবং নিজ থানা আনোয়ারায় এসে ছাত্রদের সংগঠিত করে বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে ভাষা আন্দোলনের পক্ষে মিছিল মিটিং এ নেতৃত্ব দেন। ১৯৫৩ সালে কৃতিত্বের সাথে মেট্রিক পাস করার পর ভর্তি হন চট্টগ্রাম কলেজে। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন্ওে তিনি নিজ এলাকা আনোয়ারায় জোরালো ভূমিকা রাখেন। ১৯৫৫ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে আই–এ পাস করেন। ১৯৫৭ সালে বি.এ পরীক্ষায় অংশ গ্রহণের প্রাক্কালে টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত এবং একই সময়ে স্নেহময়ী মাতার মৃত্যুর কারণে তাঁর ডিগ্রি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করা আর হয়নি।
পরবর্তীকালে আর্থিক সংকটের কারণে ১৯৫৮ সালের ১৪ জানুয়ারি চান্দগাঁও মডেল হাই স্কুলে জুনিয়র শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতায় নিয়োজিত হণ। ৬২ সালে শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলনে অংশ নেন। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনে তিনি সরাসরি জড়িয়ে পড়েন। আওয়ামী রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হয়ে বিভিন্ন সভা সমাবেশে বক্তৃতা করতে গিয়ে তিনি অল্প দিনের মধ্যে তুখোড় বক্তা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন এবং জননেতা এম এ আজিজের সংস্পর্শে আসেন।
শিক্ষকতার পাশাপাশি ১৯৬৬ সালে শিক্ষক পরীক্ষার্থী হিসেবে পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করে ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৬৭ Ñ–৬৮ শিক্ষাবর্ষে কৃতিত্বের সাথে বি.এড ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৯ সালে অসহযোগ আন্দোলনে তিনি চট্টগ্রাম ও নিজ থানা আনোয়ারায় ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসর গ্রহণের র্পূর্ব পর্যন্ত তিনি সাতকানিয়ার ডেমুসিয়া জুনিয়র হাই স্কুল, পটিয়ার দৌলতপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়, চান্দগাঁও এন এম সি মডেল হাই স্কুল, মেরিন একাডেমী উচ্চ বিদ্যালয়, বটতলী শাহ মোহছেন আউলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে একাধিক্রমে ৩৬ বৎসর প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। উল্লেখ্য যে, এ সময়কালে তিনটি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে বিদ্যালয়গুলো প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত কুমিল্লা মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্র্ডের ইংরেজি বিষয়ের পরীক্ষক, ছক বিন্যাসক ও প্রধান পরীক্ষক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। শিক্ষাক্ষেত্রে বিরল অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৯৭ সালে আনোয়ারা উপজেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে সরকারি পুরস্কারে ভূষিত হন।


Wednesday, May 23, 2018

স্মরণ: ইবসেন: বিশ্বনাটকের মহাস্থপতি

স্মরণ: ইবসেন: বিশ্বনাটকের মহাস্থপতি
আলী ফোরকান
জন্ম : ১৮৮২ সালের ২০ মার্চ
 মৃত্যু :১৯০৬ সালের ২৩ মে
ইবসেন জন্মেছিলেন নরওয়ের সমুদ্রতীরবর্তী শিয়েন শহরে ১৮৮২ সালের ২০ মার্চ তখনকার রাজধানী ক্রিস্টিয়ানিয়া; আজকের অসলো, থেকে এই শহরটি একশ মাইল দক্ষিণের ছোট্ট একটি শহরে। ইবসেন আমাদের কাছে এক নামে পরিচিত ‘আ ডলস হাউস’র নাট্যকার হিসেবে। সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত ছবি ‘গণশত্রু’ ইবসেনের ততোধিক বিখ্যাত নাটক ‘অহ ঊহবসু ড়ভ ঃযব চবড়ঢ়ষব’ থেকে অভিযোজিত। ইবসেন এই দুটি নাটকের মধ্য দিয়ে পরিবার ও সমাজে ব্যক্তির ভূমিকাকে চিহ্নিত করেছেন। আর এই ব্যক্তির ভূমিকাকে চিহ্নিত করতে কিছু বিষয়ের দিকে নজর দেওয়া যায় যেমন: ব্যক্তি, ব্যক্তির সাথে অন্যদের সম্পর্ক, সম্পর্কের সূত্র, সম্পর্কের সংঘাত, ব্যক্তির সিদ্ধান্ত ইত্যাদি।

শেক্সপীয়রের পরে বিশ্বসাহিত্যে ইবসেনের মতো নাট্যকার কমই এসেছেন বলে অনেকে মনে করেন। সুইডিস নাট্যকার অগাস্ট স্ট্রীন্ডবার্গ  ইবসেনকে তাঁর একইসঙ্গে পূর্বসূরীও হয়ে ওঠার পথে প্রধান বাধা বলে মনে করতেন। শোনা যায়, ইবসেনের ছবি নিজের লেখার টেবিলের ওপর রেখে নতুন নতুন লেখার প্রেরণা পেতেন স্ট্রীন্ডবার্গ। জেমস জয়েসের মতো  যুগন্ধর ঔপন্যাসিক ইবসেনকে বিশেষ ভক্তি করতেন, কিন্তু তাঁর দেশ নরওয়ের বিখ্যাত লেখক ন্যূট হ্যামসুন ইবসেনকে দেখতেন তীব্র সমালোচনার দৃষ্টিতে। এক সাহিত্য অনুষ্ঠানে ইবসেনের মুখের ওপরেই ন্যূট হ্যামসুন বলেছিলেন, ইবসেনের লেখা তরুণদের আর কোনো কাজে লাগবে না, তাঁর সাহিত্যও হয়ে গেছে একঘেয়ে ও বিবর্ণ। সুতরাং ভালো-মন্দ মিলেই ইবসেন তাঁর সমকাল থেকে চিরকালের দিকে এখনো অগ্রসরায়মান।
১৮৫০ সালে ‘ক্যাটিলিন’ নাটক লেখার ভেতর দিয়ে ইবসেনের নাটক লেখার সূচনা। কিন্তু নাট্যকার হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করতে তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে  দীর্ঘ ১২টি বছর। বলতে গেলে ‘ব্র্যান্ড’ (১৮৬৫) নাটকটি ইবসেনকে খ্যাতিমান করে তোলে। পরবর্তীকালে একটির পর একটি নাটক সফলতার মুখ দেখতে থাকে। ‘পিয়ের গিন্ট’ (১৮৬৭), ‘দি লীগ অব ইয়ুথ’ (১৮৬৯), ‘দি পিলারস অব সোসাইটি’ (১৮৭৭), ‘এ ডলস হাউস’ (১৮৭৯), ‘গোস্টস’ (১৮৮১), ‘অ্যান এনিমি অব দি পিপল’ (১৮৮২), ‘দি ওরাইল্ড ডাক’ (১৮৮৪), ‘রোজমার্সাহোম’ (১৮৮৬), ‘দি লেডি ফ্রম দি সী’ (১৮৮৮), ‘হেডা গাবলার’ (১৮৯০), ‘দি মাস্টার বিল্ডার’ (১৮৯২), ‘লিটল আইওলফ’ (১৮৯৪), ‘জন গ্যাব্রিয়েল বর্কম্যান’ (১৮৯৬) এবং ‘হোয়েন উই ডেড এওয়েইকেন’ (১৮৯৯) উল্লেখিত প্রত্যেকটি নাটকই বিশ্বনাট্যের ইতিহাসে একেকটি স্বার্থক নাটক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছে।
ইবসেন মারা গিয়েছিলেন ১৯০৬ সালের ২৩ মে অসলোতে। ১৯০০ সাল থেকেই ইবসেনের শরীরটা খুব খারাপ যাচ্ছিল, যে কারণে আমরা দেখতে পাই ‘হোয়েন উই  ডেড এওয়েকেইন’র পর ইবসেন আর তেমন কোনো রচনায় হাত দিতে পারেননি। সেই অর্থে বিংশ শতাব্দীর সূচনা হয় ইবসেনের নাটক ছাড়াই। কিন্তু উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে শেষ পর্যন্ত যে পঞ্চাশ বছরের সাহিত্য-জীবন ইবসেন পার করেছিলেন সেটি বিশেষভাবে বর্ণাঢ্য। নাট্যকার হিসেবে সূচনালগ্নের কিছু পরে ইবসেনকে স্বেচ্ছানির্বাসনে কাটাতে হয়েছিল ইতালি ও জার্মানিতে। উনিশশ সালের দিকে তাঁর অসুস্থতাকে চিহ্নিত করা হয়েছিল উন্মাদ রোগ হিসেবে। এ-সময়ে  ইবসেন বর্ণমালা শেখার জন্য তাঁর আশপাশের পরিচিত মানুষ ও বন্ধু-বান্ধবদের প্রতি সকরুণ অনুরোধ জানাতেন। এই কথাটি আমাদের তাঁর প্রতি করুণা না জাগিয়ে পারে না।
একজন সমাজসচেতন ও প্রতিবাদী নাট্যকার হিসেবে ইবসেন যেমন গণ্য হয়ে থাকেন, ততটাই গণ্য হয়ে ওঠেন মানুষের মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার অন্যতম বিশ্লেষণকারী নাট্যকার হিসেবে। তাঁর শেষ দিকের নাটকগুলোতে মানুষের অন্তর জগতের খোঁজ মেলে। ‘হেডা গাবলার’ নাটককে তো কেউ কেউ বীভৎস গল্প হিসেবে অভিহিত করেছেন। সেই সময়ের ‘ডেইলী টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় উল্লেখ করা হয়েছিল এই নাটক পড়লে যেন মনে হয় মর্গে ভ্রমণ করে এলাম। এ নাটক সম্পর্কে মর্গেন ব্লাডেড লিখেছিলেন: ‘ঐড়ৎৎরবফ সরংপড়ঁৎধমব ড়ভ রসধমরহধঃরড়হ’। এ নাটক পড়লে মনে হতেই পারে এডগার অ্যালেন পো-র রহস্যময় অন্ধকারাচ্ছন্ন গল্পগুলির কথা আর আধুনিক কালের ‘ন্যয়ার’ চলচ্চিত্রের কথা সেখানে অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিস্থিতিতেই ভয়ংকর সব ঘটনা ঘটে বা ভয়ংকর পরিস্থিত না ঘটলেও সবকিছু রহস্যময়তার আবহ পায়। আধুনিক জগতের নানা বিন্যাসের মূলে যে ক্ষমতা কাঠামোর নানান রকম ওলোট পালোট তার সূত্রমুখ ইবসেনের নানান নাটক থেকে আমরা পেতে পারি। এ-কথা বলাই যায় ইবসেন কেবল নাট্যকারই নন, বিশ্বাসাহিত্যের অঙ্গনে ও মানববিদ্যা চর্চার এক মহাস্থপতি।
ইবসেনের যাত্রা বাস্তববাদ থেকে আধুনিকবাদের দিকে। আধুনিকতার প্রধান প্রণোদনগুলি ইবসেনের নাটকের মধ্য দিয়ে পরিস্ফুটিত হয়েছিল। সে কারণে নাট্যকার হলেও সাহিত্যের সর্বক্ষেত্রে কবিতা উপন্যাস গল্প সবখানে ইবসেনের প্রভাব প্রবল। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, নারী-স্বাধীনতা, নাগরিক মানুষের নির্মাণ ও ক্ষয় বুঝতে হলে ইবসেনের নাটক পড়া ছাড়া আমাদের গত্যন্তর নেই। ফলে আধুনিক মানুষ আর ইবসেনীয় চেতনাকে আমরা সমার্থক বলে মনে করি।

Sunday, May 20, 2018

স্মরণ : ড. রশীদ আল ফারুকী

স্মরণ : ড. রশীদ আল ফারুকী
আলী ফোরকান
জন্ম : ১৯৪০ এর ১৫ মার্চ 
মৃত্যু :১৯৮৭ এর ১৯ ডিসেম্বর 
রশীদ আল ফারুকী ওরফে খায়ের উল বশর ১৯৪০ এর ১৫ মার্চ চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার গোপ্তাখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মোহাম্মদ নুরুল আবছার, মাতা গোলচেহরা চৌধুরী। রশীদ আল ফারুকী প্রাচীন অভিজাত আলেম পরিবারের মানুষ। হাতিয়ার অধিবাসী সুফি শাহ ভোঙ্গান শাহের উত্তর পুরুষ তিনি। তাঁর দাদা মওলানা আব্দুস সাত্তার সীতাকুণ্ড সিনিয়র মাদ্রাসায় ২৫ বছর শিক্ষকতা করেছেন। মাওলানা সাহেব মুসলমান সমাজে ইংরেজী শিক্ষার প্রবর্তক স্যার সৈয়দ আহমদের আহবানে সারা দিয়ে পুত্র মোহাম্মদ নুরুল আবছারকে ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত করেন তিনি ১৯২৪ সালে মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অর্জন করে স্বর্ণপদকে ভূর্ষিত হন। আলেম পরিবারের ইংরেজি শিক্ষিত পিতার সন্তান রশীদ আল ফারুকী এবং পীরের সন্তান পিরজাদা খায়ের উল বশর পরবর্তীতে সাহিত্যিক রশীদ আল ফারুকী।
স্থানীয় গ্রামে গোপ্তখালী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু। এখানে তিনি চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। এরপর তাঁকে ফেনীর আলীয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেয়া হয়। সেখানে তিনি চার বছর লেখাপড়া করেন। ১৯৫৮ সালে বামপন্থি রাজনীতির সংস্পর্শে এসে মাদ্রাসা শিক্ষায় আস্থা হারিয়ে ফেলেন। রাজনীতি হতে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য তাঁর পিতা তাঁকে মীরসরাইয়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সুফিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেন। সেখানে তিনি দুই বছর লেখাপড়া করেন। মাদ্রাসায় পড়লেও রাজীনীতি হতে তিনি দূরে সরে যাননি। এ অবস্থায় তাঁর পিতা তাঁকে পারিবারিক বইয়ের দোকানের ব্যবসার কাজে লাগিয়ে দেন। বইয়ের ব্যবসায় যুক্ত থাকা অবস্থায় ১৯৫৬ সালে চট্টগ্রামের ওয়াজেদিয়া মাদ্রাসা হতে ফাজিল পাস করেন। রশীদ আল ফারুকী মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিত ছিলেন কিন্তু মাদ্রাসা শিক্ষার প্রতি তাঁর কোন আগ্রহ ছিলনা। পরবর্তীতে তিনি সাধারণ শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং ১৯৬০ সালে সীতাকুণ্ড টেরিয়াল হাই স্কুল হতে দ্বিতীয় বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। সে সময় তাঁর পিতার মামাতো ভাই শুল্ক কর্মকর্তা ফোরক আহমদের জেষ্ঠ্য কন্যা মেহের–উন নিসা রুবির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
১৯৬২ সালে চট্টগ্রাম কলেজ হতে মানবিক শাখায় দ্বিতীয় উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন এবং ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বি.এ সম্মান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ও দ্বিতীয় শ্রেণি লাভ করেন।
১৯৬৩–৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যায়নকালীন সময়ে রশীদ আল ফারুকী সাহিত্য– সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পরেন। এ সংগঠন হতে “সুন্দরম” নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ছাত্রাবস্থায় ১৯৫৮ সালে পিতা নুরুল আবছার যুক্তফ্রন্টের পক্ষে চট্টগ্রাম–২ আসনে (সীতাকুণ্ড ডবলমুরিং) নির্বাচনে অংশ নেন। এ নির্বাচনে যুক্ত থাকায় তিনি ছাত্ররাজনীতির সংস্পর্শে আসেন। ১৯৫৫ সালে যুবলীগে যোগ দেন। ১৯৫৭ সালে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগ দেন। ১৯৫৮ সালে সামরিক আইনে তাঁকে গৃহবন্দি করা হয়। ১৯৬২ সালে চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্রকালীন সময়ে আইয়ুব বিরোধী শিক্ষা আন্দোলনে অংশ নেন। ১৯৬৮ সালে ঢাকায় সামরিক শাসন বিরোধী শিক্ষা আন্দোলনে অংশ থাকায় পুনরায় গ্রেফতার করা হয়। সে সময় রাজনীতি প্রাঙ্গণে তিনি শাহাজাদা খায়ের–উল বশর নামে সুপরিচিতি হয়ে উঠেন। কর্মজীবনে পরবর্তীতে রাজনীতি হতে দূরে সরে আসেন। ১৯৬৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে দ্বিতীয় শ্রেণিতে এম.এ পাস করেন।
১৯৬৭ সালে রাউজান কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগদেয়ার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। এখানে তিনি তিন বছর শিক্ষকতা করেন। ১৯৭০ এ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ ফেলো হিসেবে বাংলা বিভাগে যোগ দেন। রাউজান কলেজে অধ্যাপনাকালে তাঁর প্রথম স্ত্রীর অকাল মৃত্যু ঘটে। ১৯৭১ সালে তিনি বদরুন নিসার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদেন। ১৯৭৫ সালে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯৭৮ সালে তিনি ভারত সরকারের বৃত্তি নিয়ে উচ্চতর গবেষণার জন্য কলকাতা যান। ১৯৮১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ড. অসিত কুমার বন্দোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে “মুসলিম রচিত বাংলা উপন্যাস (১৮৮৫–১৯৩০) শীর্ষক অভিসন্দর্ভ রচনা করে তিনি এ ডিগ্রি অর্জন করেন। দেশে ফিরে এসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৮২ সালে বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতী পান। ১৯৮৬ সালের ১৬ এপ্রিল তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সভাপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং আমৃত্যু তিনি এপদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এ.এফ.রহমান হলের প্রভোস্টের দায়িত্ব পালন করেন। একই বছর তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পাবলিকেশন সমিতির সদস্য মনোনীত হন। ১৯৮৬ সালে ঢাকার বাংলা একাডেমির কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য হিসেবে কাজ করেন। সাহিত্য চর্চায় তরুণদের উজ্জীবিত ও সংগঠিত করার জন্য ১৯৮৬ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ সাহিত্য পরিষদ। শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিয়ে রাজনীতি হতে দূরে থাকলেও তিনি ছিলেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও গবেষক। বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন সাময়িকী ও গবেষণা পত্রিকায় তাঁর অনেক গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হন। বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় সাহিত্যের পাতায় তিনি নিয়মিত প্রবন্ধ রচনা করেছেন। গবেষণা সূত্রে কলিকাতায় অবস্থানকালে অর্জুন দাস ছদ্মনামে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে অনেক প্রবন্ধ লিখেছেন।
সাহিত্য চর্চার শুরুতে তিনি প্রথমে খায়ের উল বশর নামে সুপরিচিত হয়ে উঠেন। পাশাপাশি রাজনৈতিক অঙ্গনে পিরজাদা খায়ের উল বশর নামেও সুপরিচিত ছিলেন। লেখনিতে রাজনৈতিক পরিচয়ে পরিচিতি হয়ে যেতে পারে সে আশংকায় তিনি পরে লেখক হিসেবে রশীদ আল ফারুকী নামটিকে গ্রহণ করে নেন। কলকাতায় পিএইচডি গবেষণা শেষে তিনি বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের গবেষণা প্রকল্পের আওতায় আল ইসলাম পত্রিকায় “ভাষা ও সাহিত্য অধ্যায়ন” বিষয়ে গবেষণার কাজ শুরু করেন। যা তাঁর অকাল মৃত্যুতে অসমাপ্ত থেকে যায়। জীবিত অবস্থায় তাঁর সতেরটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে দশটি প্রবন্ধ গ্রন্থ, চারটি সম্পাদিত গ্রন্থ,একটি জীবনী গ্রন্থ, একটি কিশোর গ্রন্থ ও একটি অনুবাদ গ্রন্থ। এছাড়াও তাঁর বহু রচনা এখনো অগ্রন্থিত রয়েছে। ১৯৭৩ সালে তিনি মওলানা আবুল কালাম আজাদের লেখা “ইন্ডিয়া উইলস ফ্রিডম” বইটি বাংলা অনুবাদ করে তা প্রকাশের জন্য বাংলা একাডেমিতে পাণ্ডু লিপি জমা দিয়েছিলেন। বইটি অপ্রকাশিত থাকে। রশীদ আল ফারুকীর প্রকাশিত গ্রন্থ সমূহের তালিকা এখানে দেয়া হলো: ১। রুচি ও প্রগতি, প্রকাশকাল– ১৯৬৯ইং ২। বাঙলা সাহিত্যে চরিত্র চিত্রন, প্রকাশকাল –১৯৬৯ । ৩। উর্দু সাহিত্যের রুপরেখা, প্রকাশকাল –১৯৭০ । ৪। শরৎ সাহিত্য জিজ্ঞাসা, প্রকাশকাল – ১৯৭১ । ৫। হারকিউলিসের দুঃসাহসিক অভিযান, প্রকাশকাল–১৯৬৯ । ৬। মুসলিম ম্যানস্ঃ সংঘাত ও প্রতিক্রিয়া– কলিকাতা হতে প্রকাশিত ১৯৮১ ৭। বাঙলা উপন্যাসে মুসলমান লেখকদের অবদান– কলকাতা হতে প্রকাশিত ১৯৮৮, ৮। সমকালীন প্রসঙ্গ– ঢাকা হতে প্রকাশিত ১৯৮৪ ইং ৯। বাঙলার জাগরণ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ– ঢাকা হতে প্রকাশিত ১৯৮৫ ইং। ১০। নুরুন্নেসা খাতুন বিদ্যা বিনোদনী– ঢাকা হতে প্রকাশিত ১৯৮৭ ইং। ১১। ধর্ম ও রাষ্ট্র– ঢাকা হতে প্রকাশিত–১৯৮৯ ইং। ১২। মুসলিম ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থা (অনুবাদ গ্রন্থ) ঢাকা–১৯৮৮ইং। ১৩। ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব–ঢাকা ১৯৮৯ ইং সালে প্রকাশিত। এসব গ্রন্থ ছাড়াও তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থগুলো হলো, ১। আধুনিক সাহিত্যের রূপকার (সমালোচনা সংগ্রহ) ঢাকা–১৯৭৫ ইং। ২। প্রসঙ্গ ভাষা ও সাহিত্য– কলকাতা ১৯৮১ ইং। ৩। কাজী আব্দুল ওদুদ প্রসঙ্গে– চট্টগ্রাম হতে প্রকাশিত ১৯৮৭। ৪। বঙ্কিম পরিক্রমা (মুক্তধারা ঢাকা হতে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা)। ৫। নব দিগন্ত (সাহিত্য) পত্রিকা ১৯৬৮ ইং (বিবিধ সাহিত্য পত্রিকা)। ৬। আগুণ ঝড়া ফাগুন (একুশের সংকল, কলকাতা)। ৭। নবজাতক (৩টি সংখ্যা) এবং পান্ডুলিপি, শেষোক্ত “পান্ডুলিপি’ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের গবেষণাপত্র। শিক্ষকতা, গবেষণা, লেখালেখি সম্পাদনার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন পর্যায়ে সাংগঠনিক কর্মকান্ডেও জড়িত ছিলেন। ড. রশীদ আল ফারুকী বাংলাদেশ সাহিত্য পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, চট্টগ্রাম বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি, বাংলা একাডেমির কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সমিতি, উদিচী শিল্পী গোষ্ঠী, বাংলাদেশ কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, বিশ্ব মৈত্রী ও সংহতি পরিষদের সাথে সড়াসড়ি সম্পৃক্ত থেকে কাজ করেছেন। ড. রশিদ আল ফারুকী জীবন পর্যালোচনা করতে গিয়ে দেখা গেছে তিনি একই সময়ে অনেকগুলো কাজ সম্পাদন করা অফুরান প্রাণ শক্তির একজন মানুষ। অধ্যাপনা, লেখালেখি, সাংগঠনিক কর্মকান্ড নিয়ে ব্যস্ততায় নিবেদিত প্রাণ মানুষটি নিজের শরীরের দিকে কোন খেয়ালই রাখেননি। ১৯৮৭ এর শেষের দিকে তিনি হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৯৮৭ এর ১৯ ডিসেম্বর চিকিৎসারত অবস্থায় রশীদ আল ফারুকী ইহলোক ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৪৮ বছর।

Saturday, May 19, 2018

স্মরণ : ব্রুস লি: মার্শাল আর্টের এক কিংবদন্তী

স্মরণ : ব্রুস লি: মার্শাল আর্টের এক কিংবদন্তী
আলী ফোরকান
জন্ম : ১৯৪০ সালের ২৭ নভেম্বর
মৃত্যু  : ১৯৭৩ সালের ২০ জুলাই 
ব্রুস লি’র নাম জানে না বা শোনে নি এমন মানুষ খুব বেশি একটা পাওয়া যাবে না। অসামান্য প্রতিভাধর এক ব্যক্তি ছিলেন তিনি। সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে তার কোটি কোটি ভক্ত। তাদের কাছে তিনি ‘কুংফুর এক ও অদ্বিতীয় সম্রাট’। মার্শাল আর্টকে তিনি আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে নিয়ে গিয়েছিলেন চলচ্চিত্র ও দেশ-বিদেশে তার মার্শাল আর্টের নানা প্রদর্শনীর সুবাদে। তিনি ছিলেন অনেকের আদর্শ। টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত বিংশ শতাব্দীর একশো জন প্রভাবশালী ব্যক্তির মধ্যে উল্লেখযোগ্য এক নাম ছিল ব্রুস লি।
ব্রুস লি’র ফ্লাইং কিক, হাতের মুভমেন্ট ছিল চোখের পলক ফেলার চেয়েও দ্রুত, যা শুধু তার ভক্তদেরই নয়, আপামর জনসাধারণকেও মুগ্ধ করতো। অসাধারণ ছিল তার ফিটনেস। সতেজতা এবং তারুণ্যের প্রতীক ছিলেন তিনি। কাজ ছাড়া কিছুই বুঝতেন না তিনি। মার্শাল আর্ট আর অভিনয় ছাড়াও নানা বিষয়ের প্রতি আগ্রহ ছিলো তার। অবসরে আঁকতেন ছবি। কবিতা লেখার প্রতিও ছিল ঝোঁক। তার একটি কবিতা সংকলনও বের হয়েছিল। সারা জীবন এক মনে নিজের কাজটি করে গেছেন। তাকে পর্দায় দেখা ছিল ভক্তদের কাছে চরম আনন্দময় এক মুহূর্ত। তবে পর্দার বাইরে ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম একজন ব্যক্তিত্ব। আত্মকেন্দ্রিক, উদ্ধত এবং প্রচন্ড বদমেজাজী একজন মানুষ।

সত্তর দশকের শুরুর দিকে অভিনয়ের জগতে তার পথচলার সূচনা ঘটে। কিন্তু মাত্র দু’বছরের মধ্যে অসাধারণ কলাকৌশল আর অভিনয় দক্ষতায় বিশ্বের স্বনামধন্য তারকাদের সারিতে নিজের নামটি অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন ব্রুস লি। শুধু কি তাই? তিনিই এশিয়ার প্রথম অ্যাকশন হিরো, যিনি পারিশ্রমিক পেতেন মিলিয়ন ডলারেরও বেশি। ব্রুস লি তার সমস্ত ছবিতেই একক নায়ক হিসেবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী চরিত্রের ভূমিকায় অভিনয় করে গেছেন। দর্শক তার ছবির দুর্র্ধষ পাঞ্চ, অ্যাকশন এবং ফ্লায়িং কিকের দৃশ্যগুলো উপভোগ করার জন্য অধীর আগ্রহে প্রেক্ষাগৃহে অপেক্ষা করতো।

অনেকেই ব্রুস লিকে চীনা মনে করলেও তিনি কিংবা তার পরিবার কখনই চীনের অধিবাসী ছিলেন না। লি জন্মেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোতে, ১৯৪০ সালের ২৭ নভেম্বর। পিতা লি হুই চোয়েন ছিলেন একজন জনপ্রিয় পেশাদার নাট্যশিল্পী। হংকংয়ের অধিবাসী হুই চোয়েন বসবাসের উদ্দেশ্যে সপরিবারে আমেরিকায় পা রাখেন। ব্রুস লি’র মা গ্রেস নবজাতকের নাম রাখতে চেয়েছিলেন ‘ইউমেন ক্যাম’, কিন্তু হাসপাতালের নার্সের কাছে নামটির উচ্চারণ লেগেছিল বেশ খটমটে। তাই তিনি নবজাতকের বার্থ সার্টিফিকেটে নাম লেখেন ব্রুস লি। নামটি ব্রুসের বাবা-মায়ের পছন্দ হওয়ায় তারা আর নাম বদলানোর কথা ভাবেননি। ব্রুসের যখন মাত্র এক বছর বয়স, তখন পরিবারের সকলে আবার চলে আসেন হংকং-এ।
ছোটবেলা থেকেই ব্রুস লি মারামারিতে ছিলেন ওস্তাদ। সমবয়সী বন্ধুদের নিয়ে মারামারি করার জন্য গড়ে তোলেন একটি দল। কিন্তু হালকা পাতলা ব্রুস লি মারাামারিতে সবসময় পেরে উঠতেন না। আর তাই প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য তিনি শেখা শুরু করেন মার্শাল আর্ট।

কুংফুর পাশাপাশি ছোটবেলা থেকেই তার অভিনয়ের নেশা জন্মায়। বাবার সাথে স্টুডিওতে যেতেন। স্টুডিওতে শিল্পীদের অভিনয় দেখে তার অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ জন্মায়। মাত্র ছ’বছর বয়সেই ব্রুস লি ‘দ্য বিগিনিং অফ অ্যা বয়’ ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ পান। ব্রুস লি’র একজন আত্মজীবনীকার এ প্রসঙ্গে বলেছেন- “সাত বছর বয়সেই লি’র পর্দায় উপস্থিতি ছিল বেশ সাবলীল ও শক্তিশালী। সঙ্গে ছিল তার বুদ্ধিদীপ্ত উপস্থাপনা।” হংকং-এর সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার স্কুলে পড়াশোনার সময় ব্রুস লি কুংফুর পাশাপাশি উইং-চানও শিখতে শুরু করেন। এটি চাইনিজদের আত্মরক্ষার অতি উন্নত এক কৌশল। এর জন্য দরকার খুব কঠিন অনুশীলন। ধীরে ধীরে লি এ শিল্পেও পারদর্শী হয়ে ওঠেন।

ব্রাদার এডওয়ার্ড নামের এক স্কুল শিক্ষক ব্রুস লির আচার-আচরণে দুর্বিনীত ভাব দেখে তাকে শাস্তি দেয়ার জন্য একদিন স্কুলের বক্সিং রুমে নিয়ে যান এবং তার সঙ্গে বক্সিং লড়তে বলেন। লি জীবনে কোনোদিনও বক্সিং শেখেননি। কিন্তু উইং চান-এর কৌশল জানা থাকায় তা অবলম্বন করে খুব সহজেই অভিজ্ঞ প্রতিদ্বন্দ্বী শিক্ষককে ধরাশায়ী করে দেন। তিনি লি’র কৌশল দেখে খুবই খুশি হন এবং তাকে বক্সিং টিমে যুক্ত করে নেন। আর সেই বছরই জীবনের প্রথম টুর্নামেন্টে ব্রুস লি ধরাশায়ী করেন স্কুলের একটানা তিন বছরের বক্সিং চ্যাম্পিয়নকে।

লি পড়াশুনার সাথে সাথে বক্সিং ও সিনেমার অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছিলেন। অনেক সমালোচকই বলতেন, ব্রুস লি’র মারামারিতে নাচের স্বাদ পাওয়া যায়। হবেই না বা কেন? নাচ ছিল ব্রুসের কাছে অত্যন্ত প্রিয় একটি বিষয়। জনপ্রিয় প্রায় সব রকম নাচেই তার দক্ষতার প্রতিফলন দেখা যেত। ল্যাটিন আমেরিকার নাচ ‘চা-চা’-তে তিনি ছিলেন পারদর্শী। শুধু তা-ই নয়, এই নাচে তিনি হংকং-এ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। বহু পুরস্কার পেয়েছেন এই ‘চা-চা’ নাচের প্রতিযোগিতায়।

মাত্র ১৮ বছর বয়সেই বিশটিরও বেশি হংকং-এর চলচ্চিত্রে অভিনয় করে ফেলেছিলেন ব্রুস লি। দর্শকদের কাছে তিনি ‘লি সিউ লুং’ বা ‘খুদে ড্রাগন’ হিসেবে পরিচিতি পান। ধীরে ধীরে যখন তার জনপ্রিয়তা বেড়ে চলেছে, সেই সময় এশিয়ার প্রভাবশালী প্রযোজক রান লিকে তার ছবিতে কাজ করার প্রস্তাব দেন। এই প্রস্তাবে লি এত রোমাঞ্চিত হন যে, মাকে বলেই ফেলেন তিনি আর পড়াশুনা করবেন না! চলচ্চিত্রকেই তিনি পেশা হিসেব নিতে চান। কিন্তু ব্রুস লি’র মায়ের তাতে মোটেই মত ছিল না। তার মা চাইতেন আগে হাই স্কুলের পড়াশুনা শেষ হোক, তারপর যা করার লি করুক।

একবার মারামারির জন্য পুলিশের হাতে গ্রেফতারও হন লি। এসব নিয়ে তার মা বেশ উদ্বিগ্নই থাকতেন। তাই তিনি পড়াশোনার জন্য ছেলেকে আমেরিকায় পাঠিয়ে দেন। ছাত্র জীবনের বাকি সময়টুকু লি আমেরিকাতেই কাটান। সেখানে হাই স্কুলের পড়া শেষ করে তিনি ভর্তি হন ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনে। সেখানে কুংফু শিখিয়ে পড়ার খরচ জোগাড় করতেন তিনি। সেই সময় লিন্ডা এমেরি নামের এক সুইডিশ ছাত্রী কুংফু শিখতে ব্রুস লি-র কাছে আসে। আর সেখান তাদের থেকেই প্রেম, অতঃপর বিয়ে। মায়ের আপত্তি সত্ত্বেও ১৯৬৪ সালে লিন্ডাকে বিয়ে করে লি চলে আসেন ক্যালিফোর্নিয়াতে। ১৯৬৫ সালে জন্ম নেয় তাদের প্রথম সন্তান ব্র্যানডন।

মার্শাল আর্ট-এ দক্ষতা বাড়ানোর সাথে সাথে কুংফুতে নিজস্ব কিছু স্টাইল আনেন লি। সেই কৌশলের তিনি নাম দেন ‘জিৎ কুনে দো’ অর্থাৎ ঘুষির সাহায্যে শত্রুকে পরাজিত করা। ব্রুসের এই নতুন কৌশল ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। হলিউডের তারকা অভিনেতা স্টিভ ম্যাককুইন এবং জেমস কোবার্ন ছিলেন তার ছাত্র। এক ঘন্টা মারামারি শেখানোর পারিশ্রমিক হিসেবে তিনি নিতেন ২৫০ ডলার। রিচার্ড গোল্ডস্টাইন তার বই ‘দ্য ভিলেজ ভয়েস’-এ একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেন। ঘটনাটি ঘটেছিল হংকং-এর একটি লেট নাইট শো-তে। সেই শো-তে মার্শাল আর্টের কয়েকজন শিক্ষককে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তাদের মধ্যে ছিলেন ব্রুস লিও। মার্শাল আর্টের এক অভিজ্ঞ শিক্ষক অন্যদের চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলেছিলেন, সেখানে তার চেয়ে কেউ শক্তিশালী থাকলে তাকে যেন স্টেজ থেকে ছুড়ে ফেলে দেখায়। কেউই পারেননি। এরপর ব্রুস লি উঠে দাঁড়ান এবং দুম করে শিক্ষকের মুখে ঘুষি মেরে দেন। এক ঘুষিতেই ডিগবাজি খেয়ে পড়ে যান সেই অভিজ্ঞ শিক্ষক। এমনই ঘুষির জোর ছিল ব্রুস লি’র জিৎ কুনে দো-র।

ইন্সট্রাক্টর হিসেবে লির নাম-ডাক ছড়িয়ে পড়লেও চলচ্চিত্র জগতে তেমন সাফল্য পাচ্ছিলেন না তিনি। কারণ ঐ সময়ে আমেরিকান চলচ্চিত্রে এশিয়ানদের কাজ করার খুব একটা সুযোগ থাকতো না। ছোটখাট চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পেতেন এশিয়ান অভিনেতারা। ১৯৬৬ সালে ব্রুস লি টিভি সিরিজ ‘দ্য গ্রিন হর্নেট’-এ অভিনয়ের সুযোগ পান। অ্যাকশনধর্মী এই সিরিজটিতে অভিনয় করে ব্রুস লি প্রচুর পরিচিতি লাভ করেন। গ্রিন হর্নেট-এর প্রধান চরিত্র ‘কোটো’র ভূমিকায় লির দুর্দান্ত অ্যাকশনে ভরপুর অভিনয় দেখার জন্য দর্শকেরা টিভির সামনে মুখিয়ে থাকতো।

লির ইচ্ছা ছিল কুংফু নামে একটি টিভি সিরিয়ালে নায়ক হওয়ার। সেই সিরিয়ালের গল্পটি গড়ে উঠেছিল এমন একজন মার্শাল আর্ট হিরোকে নিয়ে, যিনি পশ্চিমা দেশে এসে গুন্ডাদের শায়েস্তা করেন বুদ্ধি আর কুংফুর মার দিয়ে। সম্ভবত ব্রুস লি’র উচ্চতা মাত্র পাঁচ ফুট সাড়ে সাত ইঞ্চি হওয়াতে সেই চরিত্রের জন্য অভিনয়ের সুযোগ পেয়ে যান ডেভিড ক্যারাডিন। তার উচ্চতা ছিল ছ’ফুটেরও বেশি। শুধু তা-ই নয়, ব্রুস লি ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন যে এশিয়ান বলে হলিউডের ছবিতে তিনি সুযোগ পাচ্ছেন না। তবুও জেদ চেপে গিয়েছিল তার মাথায়। শুধু অভিনেতা বলেই নয়, তারকা হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন তিনি।

এরপর সেই স্বপ্ন পূরণের জন্য সপরিবারে চলে আসেন হংকং। হংকং-এ এসে তিনি প্রযোজক রেমন্ড চো‘র সঙ্গে জুটি গড়ে তোলেন। লিকে নিয়ে রেমন্ড ‘দ্য বিগ বস’ নামে একটি কুংফু ছবি তৈরি করেন। ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর ব্রুস লি নিজে দর্শকদের প্রতিক্রিয়া দেখতে নিজেই সিনেমা হলে গিয়ে হাজির হন।

হংকং এর দর্শকরা বিভিন্ন কুংফুর ছবি দেখে অভ্যস্ত। তাই ভিন্ন কিছু দেখাতে না পারলে তাদের খুশি করা সম্ভব না লি তা জানতেন। দেখা গেলো পর্দায় ব্রুসের দুর্দান্ত ফ্লাইং কিক আর ঘুষি দেখেই দারুণ মুগ্ধ দর্শকেরা। তারা ব্রুসের মারামারি দেখতে দেখতে এতটাই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠছিল যে লাফিয়ে কেউ কেউ সিটের উপরেই উঠে পড়েছিল!

‘দ্য বিগ বস’-এর মুক্তির পরে ব্রুস লি’র ‘দ্য চাইনিজ কানেকশান’ মুক্তি পায় ১৯৭২ সালে এবং ‘রিটার্ন অফ দ্য ড্রাগন’ ১৯৭৩ সালে। এসব ছবি বক্স অফিসে এতটাই হিট হয় যে ব্রুস লি’র জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়তে থাকে। তিনি প্রথম সারির এশিয়ান ফিল্ম স্টার হয়ে উঠেন। সেই সাথে ইউরোপ এবং আমেরিকায়ও তার ভক্তের সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকে। লি সে সময় শুধু অভিনয় নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন না, তিনি চিত্রনাট্য লেখাও শিখেছিলেন এবং ছবি পরিচালনাও করছিলেন।

‘রিটার্ন অফ দ্য ড্রাগন’ চলচ্চিত্রটি অনেকেরই দেখা। এ ছবিতে আমেরিকান কারাতে চ্যাম্পিয়ান চাক নোরিস অভিনয় করেছিলেন। ছবিটিতে রোমান কলোসিয়ামে ব্রুস এবং নোরিসের একটি ফাইটিং দৃশ্যকে ক্লাসিক সিন হিসেবে অভিহিত করা হয়।

একবার চাক নোরিসকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ব্রুসের কৌশল কারো পক্ষে নকল করা সম্ভব কিনা। এর উত্তরে চাক নোরিস বলেছিলেন,”ব্রুসের স্টাইল একান্তই তার নিজস্ব।” ব্রুসের চতুর্থ ছবি ‘রিটার্ন অফ দ্য ড্রাগন’ মুক্তি পায় ‘এন্টার দ্য ড্রাগন’ এর পরে। তবে এন্টার দ্য ড্রাগন ছবিটির মুক্তি দেখে যেতে পারেন নি লি।

তখন তার বয়স মাত্র বত্রিশ, প্রচুর পরিশ্রম করে হংকং এ ‘গেম অফ ডেথ’ ছবিটি করেছিলেন এবং সে সময়ই করুণ ঘটনাটি ঘটে। ১৯৭৩ সালের ২০ জুলাই হংকংয়ের একটি অ্যাপার্টমেন্টে তার অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়।

তার এ মৃত্যু এখনো রহস্যে মোড়া। কিন্তু সে অন্য এক গল্প। সনাতন মার্শাল আর্টকে বহির্বিশ্বে জনপ্রিয় করে তোলা, পশ্চিমা সংস্কৃতির সাথে এশীয় সংস্কৃতি, বিশেষ করে চীনা সংস্কৃতির এক অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন ব্রুস লি। তার কারণে চলচ্চিত্র জগতে তৈরি হয়েছিল নতুন এক ধারা। এ ক্ষণজন্মা শিল্পীর মৃত্যুর এত বছর পরও তার ভক্তের সংখ্যা কমেনি, বরং দিনদিন বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের কাছে তিনি এখনও চির নতুন জীবন্ত এক কিংবদন্তি।

স্মরণ : কথাশিল্পী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

স্মরণ : কথাশিল্পী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
আলী ফোরকান
জন্ম : ১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বর
মৃত্যু :  ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ মে (১৩১৫ বঙ্গাব্দের ৬ জ্যৈষ্ঠ)  
কথাশিল্পী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। অমর কথাশিল্পী। তাকে বলা হয় গণমানুষের যাপিত জীবনের কুশলী রূপকার। তার লেখাই তাকে শক্তিশালী ও স্মরণীয় করে রেখেছে। তার সময়ের সাহিত্যাকাশের অনেক তারার সমারোহেও তিনি আলোকিত হয়ে উঠেছিলেন।
এই ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ মে (১৩১৫ বঙ্গাব্দের ৬ জ্যৈষ্ঠ) বিহারের সাওতাল পরগনা, বর্তমান ঝাড়খণ্ড রাজ্যের দুমকা শহরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক বাড়ি ঢাকার বিক্রমপুরে৷ তার নাম প্রবোধকুমার হলেও ডাকনাম মানিক নামেই লিখে গেছেন।

চৌদ্দ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন অষ্টম। তার পিতা হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন তদানীন্তন ঢাকা জেলার সেটেলমেন্ট বিভাগের সাব-রেজিস্টার। পিতার চাকরির সূত্রে তার শৈশব ও শিক্ষাজীবন অতিবাহিত হয়েছে বাংলা-বিহার-ওড়িষার দুমকা, আরা, সাসারাম, কলকাতা, বারাসাত, বাঁকুড়া, তমলুক, কাঁথি, মহিষাদল, গুইগাদা, শালবনি, নন্দীগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, টাঙ্গাইল প্রভৃতি শহরে। তাঁ মা নীরদাসুন্দরীর আদিনিবাস ছিল সে সময়ের পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ এই বাংলাদেশেই। প্রসিদ্ধ উপন্যাস ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’য় তিনি তার মায়ের গ্রাম গাউদিয়া’র পটভূমি রচনা করেছেন  ।

বুদ্ধদেব, জীবনানন্দ, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্তকুমার, বিষ্ণু দে, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো শক্তিমান কথাসাহিত্যিকও ছিলেন তার সমকালীন লেখক। এদের ভিড়ে মাত্র ৪৮ বছরের অল্প আয়ুষ্কালে ব্যতিক্রমী কথাশিল্পী হিসেবে নিজের নামটি স্মরণীয় করে রেখেছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। এই অল্প সময়ে তিনি বাঙালিকে যা দিয়েছেন তার কোনো পরিসংখ্যান দরকার করে না। ১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বর শক্তিশালী এই কথাসাহিত্যিকের জীবনাবসান ঘটে।

বলা হয়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রবীন্দ্রোত্তরকালে তার বলয় ছাড়িয়ে প্রান্তিক মানুষের বহির্জীবন ও অন্তর্জীবনের বিষয় বৈচিত্র্য, লড়াই ও এগিয়ে চলবার মন্ত্রণাকে সবচেয়ে সফলভবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন।

চল্লিশের দশকে ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘে’ যুক্ত হওয়া আপাদমস্তক কমিউনিজমে বিশ্বাসী সেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কলেজে বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে জীবনের প্রথম গল্প ‘অতসীমামী’ লিখে ফেলেন। তারপর আর পেছন ফিরে তাকাননি। এরপর ‘বঙ্গশ্রী’ সাহিত্য পত্রিকায় ‘দিবারাত্রীর কাব্য’ উপন্যাসটির ধারাবাহিক প্রকাশের মধ্য দিয়ে ঔপন্যাসিক হিসেবে তার যাত্রা শুরু। পরের বছর ‘পূর্ব্বাশা’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসটি। ১৯৩৫ সালে ‘জননী’, ‘দিবারাত্রীর কাব্য’ উপন্যাস এবং ‘অতসীমামী ও অন্যান্য গল্প’ গল্পগ্রন্থ প্রকাশের মধ্য দিয়ে তার গ্রন্থকার হিসেবে যাত্রা শুরু হয়। এভাবে কেবল লেখালেখিকে পেশা হিসেবে নিয়ে সামান্য উপার্জনের মাধ্যমে সংসারের হাল ধরার আশায় একে একে লিখে গেছেন ৪০টি উপন্যাস, ৩০০টিরও অধিক ছোটগল্প আর বিপুল প্রবন্ধ।

তবে সাব-ডেপুটি কালেক্টর পিতা হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুত্র হয়েও জীবনবাদী লেখক প্রবোধকুমার তথা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যক্তিজীবনে অভাব মেটেনি কোনোদিন। ক্ষুরধার লেখক মানিককে একসময় লুম্বিনি পার্ক মানসিক হাসপাতালে পর্যন্ত যেতে হয়েছিল। শেষাবধি মৃত্যুবরণ করতে হয় শোচনীয় দারিদ্র্যের মধ্যে।

বাংলা উপন্যাসের সূচনালগ্নে প্যারীচাঁদ মিত্র, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এমনকি সব্যসাচী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাসেও নিম্নবর্গের যথোচিত উন্মোচন দেখা যায়। সেখানে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় সমসাময়িক তুখোড় লেখকদের প্রভাবমুক্ত হয়ে নিজের চিন্তা ও কল্পনার গভীরতা প্রকাশ করে বিশিষ্ট হতে পেরেছেন। 

রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় ১২টি বই প্রকাশিত হলেও একটিও তিনি পাঠাননি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মন্তব্যের জন্য। জীবনানন্দ দাশও রবীন্দ্রনাথকে কবিতাগ্রন্থ পাঠিয়ে তার মতামতের জন্য কাতর অনুরোধ করেছেন; এমনকি রবীন্দ্রদ্রোহী বুদ্ধদেব বসুও রবীন্দ্রনাথকে বই পাঠিয়েছেন মতামতের জন্য। সে সময় ঠোঁট-কাটা বলে পরিচিত সমর সেনও রবীন্দ্রনাথকে চিঠিতে লেখেন, ‘আমার কবিতার বইয়ের এক কপি আপনার ঠিকানায় পাঠিয়েছি। আপনার কেমন লেগেছে জানতে পারলে বাধিত হবো।’ তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যন্ত কবিগুরুর সুপারিশ যেচেছেন। সেখানে ব্যতিক্রম কেবল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবন অভিজ্ঞতা ছিল ব্যাপক ও গভীর। ফলে তিনি জীবনের দিকটি দেখতেন তার সমগ্রতায়, খণ্ড খণ্ড করে নয়, অখণ্ডতায়।

স্মরণ :কবি গুন্টার গ্রাস

স্মরণ :কবি গুন্টার গ্রাস 
আলী ফোরকান
জন্ম :  ১৯২৭ সালের ১৬ অক্টোবর
মৃত্যু :  ২০১৫ সালের ১৩ এপ্রিল 
গুন্টার গ্রাস জন্মেছিলেন ডানজিগে ১৯২৭ সালের ১৬ অক্টোবর। গ্রাসের জন্মস্থান ডানজিগ বর্তমানে পোল্যান্ডের গিডেনস্ক শহর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বাধ্যতামূলকভাবে অংশ নিতে হয়েছিল তাঁকে। যুদ্ধবন্দি হিসেবে সাজাও খেটেছেন। ছাড়া পেয়ে শ্রমিক হিসেবে কয়লাখনিতেও কাজ করেছেন। পরে শুরু করেন লেখালেখি। ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য টিন ড্রাম’। এর পর একের পর এক প্রকাশিত হয় ‘ক্যাট অ্যান্ড মাউজ’ (১৯৬১), ‘ডগ ইয়ার্স’ (১৯৬৫)। গ্রাসের এই তিনটি উপন্যাস পরিচিত ডানজিগ ট্রিলজি নামে। ২০০৬ সালে তাঁর প্রথম আত্মজীবনী ‘পিলিং দ্য অনিয়ন’ প্রকাশিত হওয়ার পর জার্মানিতে তীব্র সমালোচনার সৃষ্টি হয়। কারণ, সেখানে গ্রাস লিখেছিলেন তিনি হিটলারের ওয়াফেন-এসএস বাহিনীর সদস্য ছিলেন। ২০১৫ সালের ১৩ এপ্রিল জার্মানির লুবেকে ৮৭ বছর বয়সে মারা যান তিনি। তবে এর আগে বিশ্বব্যাপী রাজনীতিসচেতন লেখক এবং শিল্পী হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। ১৯৯৯ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান গ্রাস। তবে শুধু লেখালেখিতেই নিজেকে বেঁধে রাখেননি গ্রাস। কবিতা ও উপন্যাসের পাশাপাশি লিখেছেন মঞ্চনাটক। গ্রাফিক ডিজাইন করেছেন, ভাস্কর্য তৈরি করেছেন, ছবি এঁকেছেন। প্যারিস রিভিউ-এ গুন্টার গ্রাস দীর্ঘ একটা সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। সাক্ষাৎকার দুই কিস্তিতে নিয়েছিলেন এলিজাবেথ গ্যাফনি। সাক্ষাৎকারে তিনি প্রাণ খুলে নিজের লেখালেখি, শৈশব, নিজ পরিবার, রাজনৈতিক মতাদর্শ ছাড়াও নানা বিষয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকারটির চুম্বকাংশ পাঠকদের জন্য-
এলিজাবেথ: কোন প্রক্রিয়ায় আপনি একজন লেখক হয়ে উঠেছিলেন?
গ্রাস: আমার মনে হয় যে সামাজিক পরিবেশ এর মধ্যে আমার বেড়ে ওঠা, সে পরিবেশে এটা করা ছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিলো না। আমি নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা মানুষ। আমাদের ছোট্ট দুকামরার একটা বাড়ি ছিলো। আমার আর আমার বোন জানতাম না নিজস্ব রুম বলে কারও কিছু থাকতে পারে। আমরা থাকতাম একই ঘরে। সেই ঘরের দুই জানালার ফাঁকে ছোট এক কোনায় আমার বই গুলো রাখতাম। শুধু কী বই, জলরঙ করার জিনিস পত্র, এমন অনেক কিছু। মাঝে মাঝে আমি অভাব অনুভব করতাম। ছোট বেলাতেই আমি আমার আত্মার চিৎকার শুনতে পেয়েছিলাম। আর সে জন্যই ছোট বেলা থেকে লিখতে আর আঁকতে শুরু করি। আজ আমার যে সহায়-সম্পত্তি তার সমস্তই হয়তো সেই সূচনার ফলাফল। চারটি ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় পড়া-শোনা করেছি। আমার শৈশবের সেই রূঢ় বাস্তবতা আর একটা ঘরের ছোট্ট কোনায় আমি আর আমার বোনের বেঁচে থাকার সেই স্মৃতিকে আমি আজও ভয় পাই।
এলিজাবেথ: এমন পরিপার্শ্বের ভেতর খেলাধুলা অথবা অন্য কোন সহজ কাজ না করে পড়া আর লেখালেখির মত কঠিন একটা বিষয় কেনো বেছে নিলেন?
গুন্টার গ্রাস: শিশু কালে আমি খুব মিথ্যাবাদী ছিলাম। সৌভাগ্যক্রমে আমার মা আবার আমার এই মিথ্যাগুলোকে খুব পছন্দ করতো। আমি তাকে মহান কিছু বলার প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলাম। আমার বয়স যখন দশ বছর তখন মা আমাকে পিয়ার গিয়স্ট নামে ডাকতো। সেই সময় আমাদের নেপলস ভ্রমণের কথা ছিলো। মা আমাকে সেই ভ্রমণ সম্বন্ধে একটা গল্প লিখতে বলেছিলো। আর তখন থেকেই আমি মিথ্যা লেখা শুরু করি। আর সেই মিথ্যাচার আমি চালিয়েই গেলাম। বারো বছর বয়সে আমি উপন্যাস লেখা শুরু করি। এটা ছিলো কাশোবিয়াম (শধংযঁনরঁস) সম্পর্কিত, যা বহু বছর পর ‘দ্য টিন ড্রাম’-এ অস্কার (ঙংশধৎ) এর দাদি অহহধ চরিত্রে রূপান্তরিত হলো। প্রথম এই উপন্যাসে আমি একটা ভুল করেছিলাম। উপন্যাসটির প্রথম অধ্যায়ের শেষের দিকে সমস্ত চরিত্রের মৃত্যু ঘটে গেলো। আমার আর শেষ করা হলো না। তবে এটাই হলো আমার উপন্যাস লেখার প্রথম শিক্ষা চরিত্র সম্বন্ধে সচেতনভাবে খুব সাবধান থাকতে হয়।
এলিজাবেথ: কোন মিথ্যা আপনাকে সব থেকে বেশি আনন্দ দিয়েছে?
গুন্টার গ্রাস: যে মিথ্যা কাউকে আঘাত করে না, কাউকে বাঁচায়। আমার অভিনব মিথ্যাচার গতানুগতিক মিথ্যাচার থেকে বেশ আলাদা। এটা আমার পেশা নয়। সত্য বড় ক্লান্তিকর, তুমি মিথ্যার সাথে সত্যকে ব্যবহার করতে পারো। এতে দোষের কিছু নেই। আমি এটা বুঝেছি যে আমার ভয়ংকর মিথ্যার কোন প্রতিক্রিয়া নেই। যদি কয়েক বছরের জার্মানির রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে কিছু লিখতাম তবে লোকে বলতো, কী নিদারুণ মিথ্যাবাদী।
এলিজাবেথ: প্রথম উপন্যাসে ব্যর্থতার পর আপনি কি করলেন?
গুন্টার গ্রাস: কবিতা আর ড্রয়িং নিয়ে আমার প্রথম কবিতার বই। প্রকৃতপক্ষে আমার কবিতায় ছিলো ড্রয়িং আর গদ্যের সমাবেশ, কখনও কখনও তা চিত্রকল্পের বাইরে, এমনকি কখনও তা শব্দ-বাক্যহীন। এরপর চব্বিশ বছর বয়সে আমি টাইপ-রায়টার কেনার সামর্থ্য অর্জন করি। দুই আঙ্গুলে লেখার পদ্ধতি আমার ভালো লাগলো। ‘দ্য টিন ড্রাম’ এর প্রথম অংশ টাইপ-রায়টারে লেখা। আমার বয়স বাড়তে লাগলো। আমি শুনছি আমার বন্ধুরা কম্পিউটারে লেখে। প্রথম খসড়া আমি হাতে লিখি। প্রিন্টার থেকে ঞযব জধঃ এর প্রথম সংস্করণ লাইনহীন বড় কাগজে বই আকারে পাই। যে কোন বই প্রকাশের আগে সাদা কাগজসহ একটা বøাইন্ড কপি আমি প্রকাশকের কাছ থেকে চেয়ে নেই। প্রথম বার হাতে লেখার পর বাকি দুই তিনবার টাইপ-রাইটারে লিখে লেখাটা শেষ করি। তিন বার না লিখলে আমি কোন বই শেষ করতে পারি না। সাধারণত চারবার সংস্করণের পরই তা মুক্তি পায়।
এলিজাবেথ: প্রতিটা খসড়া লেখার সময় কি ঘটে? প্রথম থেকে শুরু করে আবার শেষ পর্যন্ত পুনরায় লেখেন?
গুন্টার গ্রাস: না। প্রথম বার আমি খুব দ্রুত লিখি। সেক্ষেত্রে আমার পছন্দ নয় এমন অনেক বিষয় থাকে। কিন্তু দ্বিতীয় বারে লেখার সময় লেখাটি হয় দীর্ঘ, বিস্তারিত ও চ‚ড়ান্ত। হয়তো লেখাটি যথার্থ হলো তারপরও আমার মনে হতে থাকে যে ঠিক রসোত্তীর্ণ হলো না। আবার লিখতে শুরু করি প্রথম বারের স্বতঃস্ফ‚র্ততা নিয়ে; দ্বিতীয় বার যা কিছু প্রয়োজনীয় ছিলো তৃতীয় বার তাই পূরণ করি। কাজটা খুব সোজা নয়, বেশ কঠিন।
এলিজাবেথ: আপনি যখন লেখার ভেতর থাকেন তখন আপনার দৈনন্দিন কাজ কি ?
গুন্টার গ্রাস: যদি কিছু লিখি আর যদি তা হয় প্রথম খসড়া তবে সেক্ষেত্রে আমি প্রতিদিন ৫ থেকে ৭ পৃষ্ঠা লিখি। আর এটা যদি হয় তৃতীয় খসড়া সেক্ষেত্রে ৩ পৃষ্ঠার বেশী আর আগায় না প্রতিদিন। খুব ধীরে ধীরে অগ্রসর হই।
এলিজাবেথ: সাধারণত সকালে দুপুরে না রাতে লিখেন?
গুন্টার গ্রাস: কখনওই রাতে নয়। আমি রাতে লেখা বিশ্বাস করি না কারণ তখন লেখা খুব সহজে এসে যায়। আর সকালে যখন লেখাটা পড়তে বসি তখন মনে হয় কিছু হয়নি। শুরু করার জন্য আমার দিনের আলো জরুরী। ৯ টা থেকে ১০ টার মধ্যে আমি নাস্তা করি। নাস্তার পর লিখতে বসি। দুপুরে কফি পানের বিরতি তারপর আবার লেখা চলতে থাকে সন্ধ্যা ৭ টা অব্ধি।
এলিজাবেথ: কিভাবে বোঝেন একটা বই এর পর আর লেখার দরকার নেই অর্থাৎ বুঝেন এখানেই লেখা শেষ করা ভালো?
গুন্টার গ্রাস: একটা দীর্ঘ বই লেখা আমার কাছে একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া। একটা বই লিখতে ৪/৫ বছর লেগে যায়। যখন আমার মনে হয় আমি নিঃশেষ হয়ে গেছি তখন আমার মনে হয় এখানে ইতি টানা আবশ্যক।

স্মরণ : অক্টাভিও পাজ

স্মরণ : অক্টাভিও পাজ
আলী ফোরকান
জন্ম  : ৩১ মার্চ, ১৯১৪
মৃত্যু :  ১৯ এপ্রিল, ১৯৯৮
অক্টাভিও পাজ (৩১ মার্চ, ১৯১৪ - ১৯ এপ্রিল, ১৯৯৮) ছিলেন একজন মেক্সিকান কবি, লেখক, ও কূটনীতিবিদ। বিংশ শতাব্দীর লাতিন আমেরিকান সাহিত্যের তিনি অন্যতম পুরোধা। ১৯৮০ সালে পাজ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। তার অসামান্য কাজের জন্য তিনি ১৯৮১ সালে মিগুয়েল ডি সার্ভেস্তেস পুরস্কার ও ১৯৮২ সালে নিউতস্তাদত পুরস্কার পান। তার ১৯৫৭ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত লিখিত কবিতাগুলোর একটি সংকলন বের হয় ১৯৯০ সালে । ১৯৯০ সালেই পাজ নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। অক্টাভিও পাজ ১৯৯৮ সালের ১৯ এপ্রিল ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
ভাষান্তর : আকিব শিকদার
সেতু
মুহূর্ত আর মুহূর্তের মাঝে,
আমার এবং তোমার মাঝে,
সেতু নামের শব্দ।
সেখানে প্রবেশ করতেই
তোমার মাঝে তুমি অন্তরীন হও:
পৃথিবী যুক্ত হয় আর
অচল হয়ে আসে চাকার মত।
এক কূল হতে অন্যতে,
প্রতিবারই
প্রশস্ত এক দেহ:
এক রংধনু।
তার গহীন কোলে নেবো নিদ্রা আমি।
মেক্সিকোর গান
আমার পিতামহ কফি খেতে খেতে
করতেন গল্পÑ হুয়ারেজ আর পোরফিরিও,
জুয়াভ বাহিনী আর পাতেয়াদোর দস্যু দল।
টেবিলক্লথ থেকে আসতো ভেসে বারুদের গন্ধ।
আমার পিতা পানীয় পানের ফাঁকে
শোনাতেন জাপাতা আর ভিয়া
সোতো, গামা আর ফ্লোরেস মাগোন ভাইদের গল্প।
টেবিলক্লথ থেকে আসতো ভেসে বারুদের গন্ধ।
আমি নিশ্চুপ থাকতাম
আমি কার গল্প বলবো?
পথ
এই যে সুদীর্ঘ, স্থব্ধ পথ।
হাঁটি ঘোরের মধ্যে, হোঁচট খাই, গড়িয়ে পড়ি,
উঠে দাঁড়াই, চলি অন্ধের মতো, পায়ের তলা
মাড়িয়ে যায় নির্বাক পাথর আর শুকনো তৃণ।
আমার পেছনে কেউ এইরূপ পেরোলে পাথর আর ঘাস :
আমি থামতেই, থামে সেও;
দৌড়োতেই, সেও দৌড়োয়, ঘুরে দেখি : কেউ না।
সমস্তই ওড়নাজাল, দরজাহীন
শুধু পায়ের শব্দ অস্তিত্বের সাড়া দেয়,
এইসব প্রান্ত ধরে আমি ঘুরছি তো ঘুরছিই
যা চিরন্তন পথের দিকে চলে গেছে
যেখানে কেউ অপেক্ষা করে না, হাঁটে না পিছু,
যেখানে আমি এমন একজনকে পেয়েছি খুঁজে, যে হোঁচটের পর
উঠে দাঁড়িয়েছে, আমার দিকে ফিরে বলছে : কেউ না।

স্মরণ : কবি এলেন গিন্সবার্গ

স্মরণ  :  কবি এলেন গিন্সবার্গ
আলী ফোরকান
জন্ম : ১৯২৬ সালে ৩ জুন নিউজার্সিতে 
মৃত্যু   : ৫ই এপ্রিল, ১৯৯৭ সালে নিউইয়র্কে 
এলেন গিন্সবার্গ একটি ইহুদী পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। তিনি নিউ জার্সির প্যাটারসন এলাকায় বেড়ে ওঠেন। ১৯৪৩ সালে তিনি ইস্টসাইড হাই স্কুল থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পরবতীর্তে মন্টক্লেয়ার কলেজে কিছুদিন অধ্যয়নের পর কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৪৫ সালে তিনি পড়ালেখার খরচ যোগাবার জন্য একটি চাকুরীতে যোগদান করেন। তিনি সে সময় কলম্বিয়া থেকে প্রকাশিত জেস্টার হিউমার ম্যাগাজিনে কিছুদিন কাজ করেন এবং ফিলোলেক্সান সোসাইটির সভাপতি নির্বাচিত হন।

এলেন গিন্সবার্গ ভারতবর্ষে থাকাকালীন সর্বাধিক সময় কাটিয়েছিলেন কলকাতায়, ১৯৬২-১৯৬৩ সালে এবং তিকি পশ্চিমবাংলার কবিদের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন । তাঁর সঙ্গে হাংরি আন্দোলন এর কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও মলয় রায়চৌধুরীর হৃদ্যটা গড়ে ওঠে এবং তিনি আমেরিকায় ফিরে গিয়ে হাংরি আন্দোলন এর কবিদের রচনা সেখানকার প্রখ্যাত পত্রিকাগুকিতে প্রকাশের ব্যবস্হা করেছিলেন। এলেন গিন্সবার্গের বিখ্যাত কবিতা ‘হাউল’ এবং ‘ক্যাডিশ’ বাংলায় অনুবাদ করেছেন মলয় রায়চৌধুরী ।

সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড - বিখ্যাত মার্কিন কবি এলেন গিন্সবার্গ রচিত একটি কবিতা যা থেকে পরে গান করা হয়েছিল। এলেন গিন্সবার্গ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ দিকে ভারতের  কলকাতায় এসেছিলেন। কলকাতার বেশ কয়েকজন সাহিত্যিকের সাথে তার বন্ধুত্ব ছিল যার মধ্যে একজন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি সুনীলের বাড়িতেই উঠেছিলেন। তখন বাংলাদেশ থেকে অনেক শরণার্থী পশ্চিমবঙ্গ ও সীমান্তবর্তী অন্যান্য শহরে আশ্রয় নিয়েছিল। ব্রিটিশ রাজের সময় পূর্ব বাংলা ও পশ্চিমবঙ্গের সংযোগকারী সড়ক হিসেবে কাজ করতো “যশোর রোড”। অনেক বৃষ্টি হওয়ায় তখন যশোর রোড পানিতে ডুবে গিয়েছিল। সড়ক পথে না পেরে গিন্সবার্গ অবশেষে নৌকায় করে বনগাঁ পেরিয়ে বাংলাদেশের যশোর সীমান্তে পৌঁছেন। তার সাথে সুনীলও ছিলেন। তারা যশোর সীমান্ত ও এর আশপাশের শিবিরগুলোতে বসবাসকারী শরণার্থীদের দুর্দশা প্রত্যক্ষ করেন।

এই অভিজ্ঞতা থেকেই গিন্সবার্গ এই কবিতাটি লিখেছিলেন। এই দীর্ঘ কবিতার সাথে সুর দিয়ে এটিকে গানে রূপ দিয়েছিলেন তিনি। আমেরিকায় ফিরে গিয়ে তার বন্ধু বব ডিলান ও অন্যান্য বিখ্যাত গায়কদের সহায়তায় এই গান গেয়ে কনসার্ট করেছিলেন। এভাবেই বাংলাদেশী শরণার্থীদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেন গিন্সবার্গ।

এলেন গিনসবার্গ। একজন মার্কিন কবি, গীতিকার, আলোকচিত্রী এবং মঞ্চ অভিনেতা। তিনি ১৯২৬ সালে ৩ জুন নিউজার্সিতে জন্মগ্রহণ করেন। ‘ইবধঃএবহবৎধঃরড়হ৩’-এর একজন নেতৃস্থানীয় প্রচারক হিসেবেই তিনি সুপরিচিত।

গিন্সবার্গ ছিলেন যুদ্ধবিরোধী। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মার্কিন সরকার যেখানে পাকিস্তানকে সমর্থন যুগিয়েছিল সেখানে এলেন গিন্সবার্গ বাংলাদেশের পক্ষে সরব ছিলেন। কোলকাতায় তার সাহিত্যিক বন্ধুদের সাথে নিয়ে তিনি যুদ্ধের ভয়াবহতা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার সংগ্রামে নেমেছিলেন।

ওই বছরের সেপ্টেম্বরে রোলিং স্টোনের কিথ রিচার্ডস কিছু টাকা তুলে দিয়েছিলেন গিন্সবার্গের হাতে; পূর্ব বঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়েছে, হাজার হাজার বাঙালি শরণার্থী বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতের শরণার্থী শিবিরগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে, অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার তারা সেখানে— গিন্সবার্গের কাজ হবে সরেজমিন ঘুরে ওই যুদ্ধের প্রকৃত পরিস্থিতি তুলে ধরে প্রতিবেদন লেখা।

কলকাতায় গিনসবার্গের সঙ্গী হয়েছিলেন তখন বিবিসি’র হয়ে রিপোর্ট করতে আসা গীতা মেহতা। কলকাতার কয়েকজন শিল্পী-সাহিত্যিকের সঙ্গে বন্ধুত্বের সূত্রে তিনি সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়িতে ওঠেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অন্যদেরসহ গিনসবার্গকে নিয়ে ঘুরে বেড়ান শরণার্থী শিবিরগুলোতে।

তখন বাংলাদেশ থেকে অনেক শরণার্থী পশ্চিমবঙ্গ ও সীমান্তবর্তী অন্যান্য শহরে আশ্রয় নিয়েছিল। ব্রিটিশ রাজত্বের সময় পূর্ব বাংলা ও পশ্চিমবঙ্গের সংযোগকারী সড়ক হিসেবে কাজ করতো যশোর রোড।

অনেক বৃষ্টি হওয়ায় তখন যশোর রোড পানিতে ডুবে গিয়েছিল। সড়ক পথে না পেরে গিন্সবার্গ অবশেষে নৌকায় করে বনগাঁ পেরিয়ে বাংলাদেশের যশোর সীমান্তে পৌঁছেন। তার সাথে সুনীলও ছিলেন। তারা যশোর সীমান্ত ও এর আশপাশের শিবিরগুলোতে বসবাসকারী শরণার্থীদের দুর্দশা প্রত্যক্ষ করেন।

যশোর রোডের পাশে গড়ে ওঠা শরনার্থী শিবির এবং এপার থেকে ওপারে যাত্রা করা হাজার হাজার নীরিহ মানুষের নির্মম হাহাকারের প্রতিধ্বনি ফুটিয়ে তুলেছিলেন “সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড কবিতায়।”

যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গিয়ে তার বন্ধু বব ডিলান ও অন্যদের সহায়তায় এই কবিতাটিকে তিনি গানে রূপ দিয়েছিলেন। কনসার্টে এই গান গেয়ে তারা বাংলাদেশী শরণার্থীদের সহায়তার জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন।

‘দ্য ফল অব আমেরিকা’ বইয়ের সেরা কবিতাটি নিঃসন্দেহে ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। 

এই কবিতার মাধ্যমেই তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি তাঁর একাত্মতা প্রকাশ করেন এবং আমেরিকায় ফিরে গিয়ে ১৯৭১ সালের ১লা আগস্ট নিউ ইয়র্কের মডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ‘পন্ডিত রবি শংকর’ ও জর্জ হ্যারিসন আয়োজিত কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’এ অংশগ্রহণ করেন। উল্লেখ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ আয়োজন করা হয়েছিল ৭১এর বাঙলাদেশী শরনার্থিদের সাহায্যার্থে।

এই কনসার্টে জর্জ হ্যরিসন, বব ডিলান, জোয়ান বায়েজ সহ আমেরিকার আরও অনেক জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী-ই সঙ্গীত পরিবেশন করেন। পন্ডিত রবি শংকর ও অপর ভারতীয় কিংবদন্তী গায়ক আলি আকবর খানও গান পরিবেশন করেন এই কনসার্টে এবং এখান থেকে প্রায় আড়াই লাখ ডলার সংগৃহীত হয়।

এই টাকার থেকেও বড়ো ব্যাপার ছিলো এই কনসার্ট সারাবিশ্বকে একটা নাড়া দিতে সক্ষম হয়েছিলো। সবার কাছে পৌঁছে গিয়েছিলো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতার কথা এবং আমাদের গৌরবান্বিত স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা। এর পর থেকে জনমত গড়তে থাকে এবং বিশ্ব অপেক্ষা করে বাঙলাদেশ নামের একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্মের জন্য।

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অর্থ সংগ্রহের জন্য “কনসার্ট ফর বাঙলাদেশ” ছাড়াও গিন্সবার্গ ওরাশিয়ার ইয়েভগেনি ইয়েভ তুসোস্কোর মিলে কবিতা পাঠের আসরও আয়োজন করেছিলেন।

গিন্সবার্গের ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতাটি পরে ১৯৯৯সালে প্রয়াত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ তাঁর মুক্তির কথা চলচ্চিত্রে ব্যবহার করেন। প্রথমে খান মোহাম্মদ ফারাবীর অনুবাদ করা কবিতাটি গান হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন কিন্তু কবিতা থেকে গান করাটা অনেক কঠিন ছিলো তাই এটাকে গান করার দায়িত্বপড়ে তারেক মাসুদের বন্ধু প্রখ্যাত গায়িকা মৌসুমি ভৌমিকের উপর।

তিনিই এই কবিতার ভাবানুবাদ করেন এবং সুরারোপ করেন। এই গানটি তারেক মাসুদ তাঁর অপর চলচ্চিত্র ‘মুক্তির গান’-এ ব্যবহার করার জন্য গিন্সবার্গের কাছ থেকে অনুমতি এনেছিলেন কিন্তু মুক্তির গান চলচ্চিত্রের ফাইনাল এডিটিং-এর সময় এই কবিতা বাদ দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ঢুকানো হয়।

বাংলা করে যে গানটি গাওয়া হয় তা হলো:



“শত শত চোখ আকাশটা দেখে

শত শত শত মানুষের দল

যশোর রোডের দুধারে বসত

বাঁশের ছাউনি, কাদামাটি জল



কাদামাটি মাখা মানুষের দল

গাদাগাদি হয়ে আকাশটা দেখে

আকাশে বসত মরা ঈশ্বর

নালিশ জানাবে ওরা বল কাকে



ঘরহীন ওরা ঘুম নেই চোখে

যুদ্ধে ছিন্ন ঘর-বাড়ি-দেশ

মাথার ভিতরে বোমারু বিমান

এই কালো রাত কবে হবে শেষ



শত শত মুখ হায় একাত্তুর

যশোর রোড যে কত কথা বলে

এত মরা মুখ আধমরা পায়ে

পূর্ববাংলা কোলকাতা চলে



সময় চলেছে রাজপথ ধরে

যশোর রোডেতে মানুষ মিছিল

সেপ্টেম্বর হায় একাত্তুর

গরুর গাড়ি কাদা রাস্তা পিছিল



লক্ষ মানুষ ভাত চেয়ে মরে

লক্ষ মানুষ শোকে ভেসে যায়

ঘরহীন ভাসে শত শত লোক

লক্ষ জননী পাগলের প্রায়



রিফুইজি ঘরে খিদে পাওয়া শিশু

পেটগুলো সব ফুলে ফেঁপে ওঠে

এইটুকু শিশু এতবড় চোখ

দিশেহারা মা কার কাছে ছোটে



সেপ্টেম্বর হায় একাত্তুর

এত এত শুধু মানুষের মুখ

যুদ্ধ মৃত্যু তবুও স্বপ্ন

ফসলের মাঠে ফেলে আসা সুখ



কার কাছে বলি ভাত রুটি কথা

কাকে বলি কর কর কর ত্রাণ

কাকে বলি ওগো মৃত্যু থামাও

মরে যাওয়া বুকে এনে দাও প্রাণ



কাঁদ কাঁদ তুমি মানুষের দল

তোমার শরীর ক্ষত দিয়ে ঢাকা

জননীর কোলে আধপেটা শিশু

এ কেমন বাঁচা? বেঁচে মরে থাকা



ছোট ছোট তুমি মানুষের দল

তোমার ঘরেও মৃত্যুর ছায়া

গুলিতে ছিন্ন দেহ-মন-মাটি

ঘর ছেড়েছ তো মাটি মিছে মায়া



সেপ্টেম্বর হায় একাত্তুর

ঘর ভেঙে গেছে যুদ্ধের ঝড়ে

যশোর রোডের দু’ধারে মানুষ

এত এত লোক শুধু কেন মরে



শত শত চোখ আকাশটা দেখে

শত শত শত শিশু মরে গেল

যশোর রোডের যুদ্ধ ক্ষেত্রে

ছেঁড়া সংসার সব এলোমেলো



কাদামাটি মাখা মানুষের দল

গাদাগাদি হয়ে আকাশটা দেখে

আকাশে বসত মরা ইশ্বর

নালিশ জানাবে ওরা বল কাকে



শত শত মুখ হায় একাত্তুর

যশোর রোড যে কত কথা বলে

এত মরা মুখ আধমরা পায়ে

পূর্ববাংলা কোলকাতা চলে।“



গিন্সবার্গের কবিতায় সে সময়কার যুদ্ধে বিধ্বস্ত বাংলাদেশের চিত্রটিই যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বাংলাদেশের পরম বন্ধু গিন্সবার্গ ৫ই এপ্রিল, ১৯৯৭ সালে নিউইয়র্কে পরলোকগমন করেন। 
এলেন গিন্সবার্গএবং সেপ্টেম্বর অন যশোর রোডশা হ রি য়া র   সো হে লএলেন গিন্সবার্গ একটি ইহুদী পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। তিনি নিউ জার্সির প্যাটারসন এলাকায় বেড়ে ওঠেন। ১৯৪৩ সালে তিনি ইস্টসাইড হাই স্কুল থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পরবতীর্তে মন্টক্লেয়ার কলেজে কিছুদিন অধ্যয়নের পর কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৪৫ সালে তিনি পড়ালেখার খরচ যোগাবার জন্য একটি চাকুরীতে যোগদান করেন। তিনি সে সময় কলম্বিয়া থেকে প্রকাশিত জেস্টার হিউমার ম্যাগাজিনে কিছুদিন কাজ করেন এবং ফিলোলেক্সান সোসাইটির সভাপতি নির্বাচিত হন।এলেন গিন্সবার্গ ভারতবর্ষে থাকাকালীন সর্বাধিক সময় কাটিয়েছিলেন কলকাতায়, ১৯৬২-১৯৬৩ সালে এবং তিকি পশ্চিমবাংলার কবিদের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন । তাঁর সঙ্গে হাংরি আন্দোলন এর কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও মলয় রায়চৌধুরীর হৃদ্যটা গড়ে ওঠে এবং তিনি আমেরিকায় ফিরে গিয়ে হাংরি আন্দোলন এর কবিদের রচনা সেখানকার প্রখ্যাত পত্রিকাগুকিতে প্রকাশের ব্যবস্হা করেছিলেন। এলেন গিন্সবার্গের বিখ্যাত কবিতা ‘হাউল’ এবং ‘ক্যাডিশ’ বাংলায় অনুবাদ করেছেন মলয় রায়চৌধুরী ।সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড - বিখ্যাত মার্কিন কবি এলেন গিন্সবার্গ রচিত একটি কবিতা যা থেকে পরে গান করা হয়েছিল। এলেন গিন্সবার্গ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ দিকে ভারতের  কলকাতায় এসেছিলেন। কলকাতার বেশ কয়েকজন সাহিত্যিকের সাথে তার বন্ধুত্ব ছিল যার মধ্যে একজন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি সুনীলের বাড়িতেই উঠেছিলেন। তখন বাংলাদেশ থেকে অনেক শরণার্থী পশ্চিমবঙ্গ ও সীমান্তবর্তী অন্যান্য শহরে আশ্রয় নিয়েছিল। ব্রিটিশ রাজের সময় পূর্ব বাংলা ও পশ্চিমবঙ্গের সংযোগকারী সড়ক হিসেবে কাজ করতো “যশোর রোড”। অনেক বৃষ্টি হওয়ায় তখন যশোর রোড পানিতে ডুবে গিয়েছিল। সড়ক পথে না পেরে গিন্সবার্গ অবশেষে নৌকায় করে বনগাঁ পেরিয়ে বাংলাদেশের যশোর সীমান্তে পৌঁছেন। তার সাথে সুনীলও ছিলেন। তারা যশোর সীমান্ত ও এর আশপাশের শিবিরগুলোতে বসবাসকারী শরণার্থীদের দুর্দশা প্রত্যক্ষ করেন।এই অভিজ্ঞতা থেকেই গিন্সবার্গ এই কবিতাটি লিখেছিলেন। এই দীর্ঘ কবিতার সাথে সুর দিয়ে এটিকে গানে রূপ দিয়েছিলেন তিনি। আমেরিকায় ফিরে গিয়ে তার বন্ধু বব ডিলান ও অন্যান্য বিখ্যাত গায়কদের সহায়তায় এই গান গেয়ে কনসার্ট করেছিলেন। এভাবেই বাংলাদেশী শরণার্থীদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেন গিন্সবার্গ।এলেন গিনসবার্গ। একজন মার্কিন কবি, গীতিকার, আলোকচিত্রী এবং মঞ্চ অভিনেতা। তিনি ১৯২৬ সালে ৩ জুন নিউজার্সিতে জন্মগ্রহণ করেন। ‘ইবধঃএবহবৎধঃরড়হ৩’-এর একজন নেতৃস্থানীয় প্রচারক হিসেবেই তিনি সুপরিচিত।গিন্সবার্গ ছিলেন যুদ্ধবিরোধী। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মার্কিন সরকার যেখানে পাকিস্তানকে সমর্থন যুগিয়েছিল সেখানে এলেন গিন্সবার্গ বাংলাদেশের পক্ষে সরব ছিলেন। কোলকাতায় তার সাহিত্যিক বন্ধুদের সাথে নিয়ে তিনি যুদ্ধের ভয়াবহতা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার সংগ্রামে নেমেছিলেন।ওই বছরের সেপ্টেম্বরে রোলিং স্টোনের কিথ রিচার্ডস কিছু টাকা তুলে দিয়েছিলেন গিন্সবার্গের হাতে; পূর্ব বঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়েছে, হাজার হাজার বাঙালি শরণার্থী বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতের শরণার্থী শিবিরগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে, অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার তারা সেখানে— গিন্সবার্গের কাজ হবে সরেজমিন ঘুরে ওই যুদ্ধের প্রকৃত পরিস্থিতি তুলে ধরে প্রতিবেদন লেখা।কলকাতায় গিনসবার্গের সঙ্গী হয়েছিলেন তখন বিবিসি’র হয়ে রিপোর্ট করতে আসা গীতা মেহতা। কলকাতার কয়েকজন শিল্পী-সাহিত্যিকের সঙ্গে বন্ধুত্বের সূত্রে তিনি সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়িতে ওঠেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অন্যদেরসহ গিনসবার্গকে নিয়ে ঘুরে বেড়ান শরণার্থী শিবিরগুলোতে।তখন বাংলাদেশ থেকে অনেক শরণার্থী পশ্চিমবঙ্গ ও সীমান্তবর্তী অন্যান্য শহরে আশ্রয় নিয়েছিল। ব্রিটিশ রাজত্বের সময় পূর্ব বাংলা ও পশ্চিমবঙ্গের সংযোগকারী সড়ক হিসেবে কাজ করতো যশোর রোড।অনেক বৃষ্টি হওয়ায় তখন যশোর রোড পানিতে ডুবে গিয়েছিল। সড়ক পথে না পেরে গিন্সবার্গ অবশেষে নৌকায় করে বনগাঁ পেরিয়ে বাংলাদেশের যশোর সীমান্তে পৌঁছেন। তার সাথে সুনীলও ছিলেন। তারা যশোর সীমান্ত ও এর আশপাশের শিবিরগুলোতে বসবাসকারী শরণার্থীদের দুর্দশা প্রত্যক্ষ করেন।যশোর রোডের পাশে গড়ে ওঠা শরনার্থী শিবির এবং এপার থেকে ওপারে যাত্রা করা হাজার হাজার নীরিহ মানুষের নির্মম হাহাকারের প্রতিধ্বনি ফুটিয়ে তুলেছিলেন “সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড কবিতায়।”যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গিয়ে তার বন্ধু বব ডিলান ও অন্যদের সহায়তায় এই কবিতাটিকে তিনি গানে রূপ দিয়েছিলেন। কনসার্টে এই গান গেয়ে তারা বাংলাদেশী শরণার্থীদের সহায়তার জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন।‘দ্য ফল অব আমেরিকা’ বইয়ের সেরা কবিতাটি নিঃসন্দেহে ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। ১৯৮২ সালে ডাইরেক্টর বেন পসেট, আমস্টারডামের ঙহব ডড়ৎষফ চড়বঃৎু-তে স্টিভেনটেইলর এবং গিন্সবার্গকে প্রয়োজনীয় শিল্পী এবং রেকর্ডিং সুবিধা দেন। রেকর্ডিং-এরজন্য স্বরলিপি লিখেছেন স্টিভেন; সব আয়োজন শেষে গরষশু ডধু ঞযবধঃবৎ রেকর্ড করা হয় ঝঃৎরহম ছঁধৎঃবঃ - ঝবঢ়ঃবসনবৎ ড়হ ঔবংংড়ৎব জড়ধফ ১৯৮৩তে। শিল্পী ছিলেন গিন্সবার্গ নিজেই। এই কবিতার মাধ্যমেই তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি তাঁর একাত্মতা প্রকাশ করেন এবং আমেরিকায় ফিরে গিয়ে ১৯৭১ সালের ১লা আগস্ট নিউ ইয়র্কের মডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ‘পন্ডিত রবি শংকর’ ও জর্জ হ্যারিসন আয়োজিত কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’এ অংশগ্রহণ করেন। উল্লেখ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ আয়োজন করা হয়েছিল ৭১এর বাঙলাদেশী শরনার্থিদের সাহায্যার্থে।এই কনসার্টে জর্জ হ্যরিসন, বব ডিলান, জোয়ান বায়েজ সহ আমেরিকার আরও অনেক জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী-ই সঙ্গীত পরিবেশন করেন। পন্ডিত রবি শংকর ও অপর ভারতীয় কিংবদন্তী গায়ক আলি আকবর খানও গান পরিবেশন করেন এই কনসার্টে এবং এখান থেকে প্রায় আড়াই লাখ ডলার সংগৃহীত হয়।এই টাকার থেকেও বড়ো ব্যাপার ছিলো এই কনসার্ট সারাবিশ্বকে একটা নাড়া দিতে সক্ষম হয়েছিলো। সবার কাছে পৌঁছে গিয়েছিলো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতার কথা এবং আমাদের গৌরবান্বিত স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা। এর পর থেকে জনমত গড়তে থাকে এবং বিশ্ব অপেক্ষা করে বাঙলাদেশ নামের একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্মের জন্য।স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অর্থ সংগ্রহের জন্য “কনসার্ট ফর বাঙলাদেশ” ছাড়াও গিন্সবার্গ ওরাশিয়ার ইয়েভগেনি ইয়েভ তুসোস্কোর মিলে কবিতা পাঠের আসরও আয়োজন করেছিলেন।গিন্সবার্গের ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতাটি পরে ১৯৯৯সালে প্রয়াত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ তাঁর মুক্তির কথা চলচ্চিত্রে ব্যবহার করেন। প্রথমে খান মোহাম্মদ ফারাবীর অনুবাদ করা কবিতাটি গান হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন কিন্তু কবিতা থেকে গান করাটা অনেক কঠিন ছিলো তাই এটাকে গান করার দায়িত্বপড়ে তারেক মাসুদের বন্ধু প্রখ্যাত গায়িকা মৌসুমি ভৌমিকের উপর।তিনিই এই কবিতার ভাবানুবাদ করেন এবং সুরারোপ করেন। এই গানটি তারেক মাসুদ তাঁর অপর চলচ্চিত্র ‘মুক্তির গান’-এ ব্যবহার করার জন্য গিন্সবার্গের কাছ থেকে অনুমতি এনেছিলেন কিন্তু মুক্তির গান চলচ্চিত্রের ফাইনাল এডিটিং-এর সময় এই কবিতা বাদ দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ঢুকানো হয়।বাংলা করে যে গানটি গাওয়া হয় তা হলো:
“শত শত চোখ আকাশটা দেখেশত শত শত মানুষের দলযশোর রোডের দুধারে বসতবাঁশের ছাউনি, কাদামাটি জল
কাদামাটি মাখা মানুষের দলগাদাগাদি হয়ে আকাশটা দেখেআকাশে বসত মরা ঈশ্বরনালিশ জানাবে ওরা বল কাকে
ঘরহীন ওরা ঘুম নেই চোখেযুদ্ধে ছিন্ন ঘর-বাড়ি-দেশমাথার ভিতরে বোমারু বিমানএই কালো রাত কবে হবে শেষ
শত শত মুখ হায় একাত্তুরযশোর রোড যে কত কথা বলেএত মরা মুখ আধমরা পায়েপূর্ববাংলা কোলকাতা চলে
সময় চলেছে রাজপথ ধরেযশোর রোডেতে মানুষ মিছিলসেপ্টেম্বর হায় একাত্তুরগরুর গাড়ি কাদা রাস্তা পিছিল
লক্ষ মানুষ ভাত চেয়ে মরেলক্ষ মানুষ শোকে ভেসে যায়ঘরহীন ভাসে শত শত লোকলক্ষ জননী পাগলের প্রায়
রিফুইজি ঘরে খিদে পাওয়া শিশুপেটগুলো সব ফুলে ফেঁপে ওঠেএইটুকু শিশু এতবড় চোখদিশেহারা মা কার কাছে ছোটে
সেপ্টেম্বর হায় একাত্তুরএত এত শুধু মানুষের মুখযুদ্ধ মৃত্যু তবুও স্বপ্নফসলের মাঠে ফেলে আসা সুখ
কার কাছে বলি ভাত রুটি কথাকাকে বলি কর কর কর ত্রাণকাকে বলি ওগো মৃত্যু থামাওমরে যাওয়া বুকে এনে দাও প্রাণ
কাঁদ কাঁদ তুমি মানুষের দলতোমার শরীর ক্ষত দিয়ে ঢাকাজননীর কোলে আধপেটা শিশুএ কেমন বাঁচা? বেঁচে মরে থাকা
ছোট ছোট তুমি মানুষের দলতোমার ঘরেও মৃত্যুর ছায়াগুলিতে ছিন্ন দেহ-মন-মাটিঘর ছেড়েছ তো মাটি মিছে মায়া
সেপ্টেম্বর হায় একাত্তুরঘর ভেঙে গেছে যুদ্ধের ঝড়েযশোর রোডের দু’ধারে মানুষএত এত লোক শুধু কেন মরে
শত শত চোখ আকাশটা দেখেশত শত শত শিশু মরে গেলযশোর রোডের যুদ্ধ ক্ষেত্রেছেঁড়া সংসার সব এলোমেলো
কাদামাটি মাখা মানুষের দলগাদাগাদি হয়ে আকাশটা দেখেআকাশে বসত মরা ইশ্বরনালিশ জানাবে ওরা বল কাকে
শত শত মুখ হায় একাত্তুরযশোর রোড যে কত কথা বলেএত মরা মুখ আধমরা পায়েপূর্ববাংলা কোলকাতা চলে।“
গিন্সবার্গের কবিতায় সে সময়কার যুদ্ধে বিধ্বস্ত বাংলাদেশের চিত্রটিই যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বাংলাদেশের পরম বন্ধু গিন্সবার্গ ৫ই এপ্রিল, ১৯৯৭ সালে নিউইয়র্কে পরলোকগমন করেন। 

স্মরণ :কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ

স্মরণ :কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ
আলী ফোরকান
জন্ম  : ১৯৩৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি 
মৃত্যু :  ২০০১ সালের ১৯ মার্চ
কবিতা শোনার মানসিকতা যার নেই, তাকে সরাসরি ছুড়ে ফেলেছেন কবি। কবির এই সাহস অদম্য। সত্যিই তো যে কবিতা শুনতে জানে না সে সমস্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত। কবিতা আমাদের মুক্তির পথ দেখায়। কবিতার এক একটি চরণ স্বপ্ন দেখায় অসম্ভবকে জয় করার। অথৈ সাগরে যুদ্ধ বিদ্ধস্ত নাবিকের কাছে কবিতা জীবন বাঁচানোর একখ- শক্ত পাটাতন। কবি অত্র কবিতা ক্রীতদাসের প্রসঙ্গ এনেছেন। যথার্থ সে প্রসঙ্গ। সেই সময়ে তাদের হাতে তো আমরা ক্রীতদাসের মতো বুন্দি ছিলাম। কত সহজ ভাষায়, কত গভীরের কথাগুলো বলেছেন কবি। কবিতা ছাড়া কি এসব সম্ভব? কবির স্বার্থকতাই যেন এখানে। খুব সহজ ভাষায়, গভীরের অনুভূতি যিনি প্রকাশ করে গেছেন, তিনি আর কেউ নন, তিনি কিংবদন্তির কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের কালপুরুষ, একুশের প্রথম সংকলনে লেখা ‘কোন এক মাকে’ কবিতার কবি, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ। তিনি একাধারে কবি, গীতিকার ও উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা এবং মন্ত্রী ছিলেন। তাঁর দুটি দীর্ঘ কবিতা ‘আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি’ এবং ‘বৃষ্টি ও সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা’ আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ভান্ডারে অভূতপূর্ব সংযোজন।
বাংলাদেশের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ছিল বলিষ্ঠ ভূমিকা। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্রসমাজের আন্দোলন যখন চরম আকার ধারণ করেছিল, তখন শাসক গোষ্ঠী ছাত্রদের মিছিলে ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মিছিল বের করলে পুলিশ সেই মিছিলে গুলি বর্ষণ করে এবং শহিদ হয় রফিক, সালাম, জব্বার, বরকত প্রমুখ। ১৯৫২ সালে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ‘৫২ ভাষা আন্দোলনের প্রতিটি কর্মকা-ে, মিছিলে, মিটিংএ তাঁর উপস্থিতি ছিল সরব। ‘৫২-র সেই মিছিল, পুলিশের গুলিবর্ষণ, শহিদ হওয়া ছাত্রদের লাশ তাঁর মনে গভীর বেদনার সৃষ্টি করেছিল। সেই বেদনা থেকেই পরবর্তীতে জন্ম নিয়েছিল তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘কোন এক মাকে’। বাংলাদেশের সমস্ত প্রান্তকে উন্মাতাল করে দেওয়া একুশের ভিন্নতর এক ব্যঞ্জনা প্রকাশিত হয়েছিল ‘কোনো এক মাকে’ কবিতায়। খোকা, যে শহীদ হয়েছে ভাষা-আন্দোলনে, আর যে কখনও উড়কি ধানের মুড়কি হাতে প্রতীক্ষারত মায়ের কাছে ফিরে আসবে না, মা তা কিছুতেই বুঝতে চায় না। এ কবিতার শরীরে ও সত্তায় প্রবহমান শহীদের রক্ত-নিংড়ানো আবেগ, যে-আবেগের ধারাজলে স্নাত হয় বাঙালি। গ্রাম থেকে আগত এক তরুণের মৃত্যুবেদনাই এই কবিতার মূল বিষয়। সাদামাটা উপমা। রূপকল্পে স্বরবৃত্তের বাঁধন। বর্ণনায় নেই অতিকথন, নেই এলিয়ে পড়া ভাব। টানটান ভঙ্গিতে বর্ণনা করে গেছেন মায়ের অনুভূতিকে। ছেলের ভালো লাগার আর ভালোবাসার বিষয়গুলোকে কবি বর্ণনা করেছেন সহজ সুরে। শব্দের অর্থদ্বৈততা নেই, নেই সাঙ্কেতিকতা বা রূপকের জটিলতা। সহজ সরল বর্ণনা।
কিংবদন্তির কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ পঞ্চাশ দশকের প্রধান কবিদের একজন। ভাষা আন্দোলন ছিল তাঁর কাব্য রচনার মূল প্রেরণা। পঞ্চাশের দশকে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ প্রধানত লিখতেন ছড়া । এই সময়ে তিনি কিছু বিদেশী কবিতারও অনুবাদ করেছেন । বেশ কয়েক বছর ছড়ায় নিজেকে প্রকাশ করার পর তিনি কবিতার মূলধারায় কাজ করতে শুরু করেন । গদ্যকবিতা তাঁর উচ্চারনের অবলম্বন হয়ে দেখা দেয় ।
‘আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি’ থেকে তাঁর কাব্যে আসে নতুন বাঁক । র্দীঘ এই কবিতাটি প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে সবাই আবিষ্কার করেন নতুন এক আবু জাফর ওবায়দুল্লাহকে । কবিতাটি অসামান্য জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। তারপর একই ধারায় আমরা পেতে থাকি ‘বৃস্টি ও সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা’ এবং ‘আমার সময়’ এর মতো চমৎকার কবিতা । দেশ, কাল এবং ঐতিহ্যে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর কবিতা ব্যক্তির সংকট, সংগ্রাম ও আকাঙ্খার সঙ্গে যুক্ত হয়ে উঠে এসেছে।
কাব্যের আঙ্গিক গঠনে এবং শব্দ যোজনার বৈশিষ্ট্য কৌশল তাঁর কবিতায় স্বাতন্ত্র্য চিহ্ন ব্যবহার করে। তিনি লোকজ ঐতিহ্য ব্যবহার করে ছড়ার আঙ্গিকে কবিতা লিখেছেন। শব্দকে সুন্দর ও সাবলীলভাবে সাজিয়ে কবিতা লেখায় আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ তৈরি করেছিলেন নিজস্ব ঢঙ।
তিনি তাঁর কাব্যরীতিতে মূলত দুটি প্রবণতাকে অনুসরণ করেছেন : একটি তাঁর প্রথম জীবনের প্রিয় গীতিমূখ্য কাব্যরীতি আর অন্যটি মহাকাব্যিক। আশির দশক থেকে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ মহাকাব্যিক কাব্যরীতিতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন।
যুদ্ধকালীন সময়ে আমাদের চৈতন্যের জাগরণে কবি তুলে ধরেছেন প্রত্যয়দীপ্ত শব্দমালায়। সমবেত বাঙালির আত্মজাগরণে তিনি লিখেছেন-
‘যে দিন রাজশক্তি আমাদের আঘাত করল
সেদিন আমরা প্রাচীন সঙ্গীতের মতো
ঋজু ও সংহত হলাম
পর্বতশৃঙ্গের মতো মহাকাশকে স্পর্শ করলাম,
দিক চক্রবালের মতো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হলাম
এবং শ্বেত সন্ত্রাসকে
সমূলে উৎপাটিত করলাম
সেদিন আমরা সমবেত কন্ঠে
কবিতাকে ধারণ করলাম।’
মুক্তিযোদ্ধা সেই অমর কিংবদন্তি যতটা আবেগ ও বাস্তবতায় কবিতা লিখতে পারেন আমরা সাধারণরা তার কতটুকুই বা পারি? তার বলাটা কবিতার মতোই যুগান্তকারী। আপোষহীন কঠিন সময়ের তিনি উচ্চারণ করেছেন চরম বাস্তবতার কথা। কবিতার প্রতি কত নিগূঢ় ভালোবাসা থাকলে এত জীবন্ত, সাহসী, অবিনাশী বক্তব্যের গতিময়তা উপস্থাপন করা যায় কবি তাই দেখিয়েছেন।
১৯৩৪ সাল। ব্রিটিশ সামরাজ্যের সূর্য তখন পটে বসছে। বিশ্বের দিকে দিকে স্বাধিকার আন্দোলনের দাবীতে ব্রিটিশ শোষণে অতিষ্ট বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী সোচ্চার হয়ে উঠছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অস্থির ডামাডোল পেরিয়ে আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে সমগ্র বিশ্ব যখন এক অস্থির আশঙ্কায় কম্পমান। তখনই সেই ক্রান্তিলগ্নে ১৯৩৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জেলাশহর বরিশালে কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ জন্ম গ্রহণ করেন। ব্রিটিশযুগে জন্ম ও বেড়ে ওঠা, পাকিস্তান যুগে যৌবন এবং বাংলাদেশে দেখেছেন নিজের পরিণতি ও সফল পরিসমাপ্তি। ত্রিকালদর্শী এই মহতী পুরুষ, মহান কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ প্রায় এক বৎসর অসুস্থ থাকার পর ২০০১ সালের ১৯ মার্চ ৬৭ বছর বয়সে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।