স্মরণ : কবি এলেন গিন্সবার্গ
আলী ফোরকান
জন্ম : ১৯২৬ সালে ৩ জুন নিউজার্সিতে
মৃত্যু : ৫ই এপ্রিল, ১৯৯৭ সালে নিউইয়র্কে
এলেন গিন্সবার্গ একটি ইহুদী পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। তিনি নিউ জার্সির প্যাটারসন এলাকায় বেড়ে ওঠেন। ১৯৪৩ সালে তিনি ইস্টসাইড হাই স্কুল থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পরবতীর্তে মন্টক্লেয়ার কলেজে কিছুদিন অধ্যয়নের পর কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৪৫ সালে তিনি পড়ালেখার খরচ যোগাবার জন্য একটি চাকুরীতে যোগদান করেন। তিনি সে সময় কলম্বিয়া থেকে প্রকাশিত জেস্টার হিউমার ম্যাগাজিনে কিছুদিন কাজ করেন এবং ফিলোলেক্সান সোসাইটির সভাপতি নির্বাচিত হন।
এলেন গিন্সবার্গ ভারতবর্ষে থাকাকালীন সর্বাধিক সময় কাটিয়েছিলেন কলকাতায়, ১৯৬২-১৯৬৩ সালে এবং তিকি পশ্চিমবাংলার কবিদের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন । তাঁর সঙ্গে হাংরি আন্দোলন এর কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও মলয় রায়চৌধুরীর হৃদ্যটা গড়ে ওঠে এবং তিনি আমেরিকায় ফিরে গিয়ে হাংরি আন্দোলন এর কবিদের রচনা সেখানকার প্রখ্যাত পত্রিকাগুকিতে প্রকাশের ব্যবস্হা করেছিলেন। এলেন গিন্সবার্গের বিখ্যাত কবিতা ‘হাউল’ এবং ‘ক্যাডিশ’ বাংলায় অনুবাদ করেছেন মলয় রায়চৌধুরী ।
সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড - বিখ্যাত মার্কিন কবি এলেন গিন্সবার্গ রচিত একটি কবিতা যা থেকে পরে গান করা হয়েছিল। এলেন গিন্সবার্গ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ দিকে ভারতের কলকাতায় এসেছিলেন। কলকাতার বেশ কয়েকজন সাহিত্যিকের সাথে তার বন্ধুত্ব ছিল যার মধ্যে একজন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি সুনীলের বাড়িতেই উঠেছিলেন। তখন বাংলাদেশ থেকে অনেক শরণার্থী পশ্চিমবঙ্গ ও সীমান্তবর্তী অন্যান্য শহরে আশ্রয় নিয়েছিল। ব্রিটিশ রাজের সময় পূর্ব বাংলা ও পশ্চিমবঙ্গের সংযোগকারী সড়ক হিসেবে কাজ করতো “যশোর রোড”। অনেক বৃষ্টি হওয়ায় তখন যশোর রোড পানিতে ডুবে গিয়েছিল। সড়ক পথে না পেরে গিন্সবার্গ অবশেষে নৌকায় করে বনগাঁ পেরিয়ে বাংলাদেশের যশোর সীমান্তে পৌঁছেন। তার সাথে সুনীলও ছিলেন। তারা যশোর সীমান্ত ও এর আশপাশের শিবিরগুলোতে বসবাসকারী শরণার্থীদের দুর্দশা প্রত্যক্ষ করেন।
এই অভিজ্ঞতা থেকেই গিন্সবার্গ এই কবিতাটি লিখেছিলেন। এই দীর্ঘ কবিতার সাথে সুর দিয়ে এটিকে গানে রূপ দিয়েছিলেন তিনি। আমেরিকায় ফিরে গিয়ে তার বন্ধু বব ডিলান ও অন্যান্য বিখ্যাত গায়কদের সহায়তায় এই গান গেয়ে কনসার্ট করেছিলেন। এভাবেই বাংলাদেশী শরণার্থীদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেন গিন্সবার্গ।
এলেন গিনসবার্গ। একজন মার্কিন কবি, গীতিকার, আলোকচিত্রী এবং মঞ্চ অভিনেতা। তিনি ১৯২৬ সালে ৩ জুন নিউজার্সিতে জন্মগ্রহণ করেন। ‘ইবধঃএবহবৎধঃরড়হ৩’-এর একজন নেতৃস্থানীয় প্রচারক হিসেবেই তিনি সুপরিচিত।
গিন্সবার্গ ছিলেন যুদ্ধবিরোধী। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মার্কিন সরকার যেখানে পাকিস্তানকে সমর্থন যুগিয়েছিল সেখানে এলেন গিন্সবার্গ বাংলাদেশের পক্ষে সরব ছিলেন। কোলকাতায় তার সাহিত্যিক বন্ধুদের সাথে নিয়ে তিনি যুদ্ধের ভয়াবহতা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার সংগ্রামে নেমেছিলেন।
ওই বছরের সেপ্টেম্বরে রোলিং স্টোনের কিথ রিচার্ডস কিছু টাকা তুলে দিয়েছিলেন গিন্সবার্গের হাতে; পূর্ব বঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়েছে, হাজার হাজার বাঙালি শরণার্থী বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতের শরণার্থী শিবিরগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে, অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার তারা সেখানে— গিন্সবার্গের কাজ হবে সরেজমিন ঘুরে ওই যুদ্ধের প্রকৃত পরিস্থিতি তুলে ধরে প্রতিবেদন লেখা।
কলকাতায় গিনসবার্গের সঙ্গী হয়েছিলেন তখন বিবিসি’র হয়ে রিপোর্ট করতে আসা গীতা মেহতা। কলকাতার কয়েকজন শিল্পী-সাহিত্যিকের সঙ্গে বন্ধুত্বের সূত্রে তিনি সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়িতে ওঠেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অন্যদেরসহ গিনসবার্গকে নিয়ে ঘুরে বেড়ান শরণার্থী শিবিরগুলোতে।
তখন বাংলাদেশ থেকে অনেক শরণার্থী পশ্চিমবঙ্গ ও সীমান্তবর্তী অন্যান্য শহরে আশ্রয় নিয়েছিল। ব্রিটিশ রাজত্বের সময় পূর্ব বাংলা ও পশ্চিমবঙ্গের সংযোগকারী সড়ক হিসেবে কাজ করতো যশোর রোড।
অনেক বৃষ্টি হওয়ায় তখন যশোর রোড পানিতে ডুবে গিয়েছিল। সড়ক পথে না পেরে গিন্সবার্গ অবশেষে নৌকায় করে বনগাঁ পেরিয়ে বাংলাদেশের যশোর সীমান্তে পৌঁছেন। তার সাথে সুনীলও ছিলেন। তারা যশোর সীমান্ত ও এর আশপাশের শিবিরগুলোতে বসবাসকারী শরণার্থীদের দুর্দশা প্রত্যক্ষ করেন।
যশোর রোডের পাশে গড়ে ওঠা শরনার্থী শিবির এবং এপার থেকে ওপারে যাত্রা করা হাজার হাজার নীরিহ মানুষের নির্মম হাহাকারের প্রতিধ্বনি ফুটিয়ে তুলেছিলেন “সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড কবিতায়।”
যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গিয়ে তার বন্ধু বব ডিলান ও অন্যদের সহায়তায় এই কবিতাটিকে তিনি গানে রূপ দিয়েছিলেন। কনসার্টে এই গান গেয়ে তারা বাংলাদেশী শরণার্থীদের সহায়তার জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন।
‘দ্য ফল অব আমেরিকা’ বইয়ের সেরা কবিতাটি নিঃসন্দেহে ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’।
এই কবিতার মাধ্যমেই তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি তাঁর একাত্মতা প্রকাশ করেন এবং আমেরিকায় ফিরে গিয়ে ১৯৭১ সালের ১লা আগস্ট নিউ ইয়র্কের মডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ‘পন্ডিত রবি শংকর’ ও জর্জ হ্যারিসন আয়োজিত কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’এ অংশগ্রহণ করেন। উল্লেখ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ আয়োজন করা হয়েছিল ৭১এর বাঙলাদেশী শরনার্থিদের সাহায্যার্থে।
এই কনসার্টে জর্জ হ্যরিসন, বব ডিলান, জোয়ান বায়েজ সহ আমেরিকার আরও অনেক জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী-ই সঙ্গীত পরিবেশন করেন। পন্ডিত রবি শংকর ও অপর ভারতীয় কিংবদন্তী গায়ক আলি আকবর খানও গান পরিবেশন করেন এই কনসার্টে এবং এখান থেকে প্রায় আড়াই লাখ ডলার সংগৃহীত হয়।
এই টাকার থেকেও বড়ো ব্যাপার ছিলো এই কনসার্ট সারাবিশ্বকে একটা নাড়া দিতে সক্ষম হয়েছিলো। সবার কাছে পৌঁছে গিয়েছিলো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতার কথা এবং আমাদের গৌরবান্বিত স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা। এর পর থেকে জনমত গড়তে থাকে এবং বিশ্ব অপেক্ষা করে বাঙলাদেশ নামের একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্মের জন্য।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অর্থ সংগ্রহের জন্য “কনসার্ট ফর বাঙলাদেশ” ছাড়াও গিন্সবার্গ ওরাশিয়ার ইয়েভগেনি ইয়েভ তুসোস্কোর মিলে কবিতা পাঠের আসরও আয়োজন করেছিলেন।
গিন্সবার্গের ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতাটি পরে ১৯৯৯সালে প্রয়াত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ তাঁর মুক্তির কথা চলচ্চিত্রে ব্যবহার করেন। প্রথমে খান মোহাম্মদ ফারাবীর অনুবাদ করা কবিতাটি গান হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন কিন্তু কবিতা থেকে গান করাটা অনেক কঠিন ছিলো তাই এটাকে গান করার দায়িত্বপড়ে তারেক মাসুদের বন্ধু প্রখ্যাত গায়িকা মৌসুমি ভৌমিকের উপর।
তিনিই এই কবিতার ভাবানুবাদ করেন এবং সুরারোপ করেন। এই গানটি তারেক মাসুদ তাঁর অপর চলচ্চিত্র ‘মুক্তির গান’-এ ব্যবহার করার জন্য গিন্সবার্গের কাছ থেকে অনুমতি এনেছিলেন কিন্তু মুক্তির গান চলচ্চিত্রের ফাইনাল এডিটিং-এর সময় এই কবিতা বাদ দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ঢুকানো হয়।
বাংলা করে যে গানটি গাওয়া হয় তা হলো:
“শত শত চোখ আকাশটা দেখে
শত শত শত মানুষের দল
যশোর রোডের দুধারে বসত
বাঁশের ছাউনি, কাদামাটি জল
কাদামাটি মাখা মানুষের দল
গাদাগাদি হয়ে আকাশটা দেখে
আকাশে বসত মরা ঈশ্বর
নালিশ জানাবে ওরা বল কাকে
ঘরহীন ওরা ঘুম নেই চোখে
যুদ্ধে ছিন্ন ঘর-বাড়ি-দেশ
মাথার ভিতরে বোমারু বিমান
এই কালো রাত কবে হবে শেষ
শত শত মুখ হায় একাত্তুর
যশোর রোড যে কত কথা বলে
এত মরা মুখ আধমরা পায়ে
পূর্ববাংলা কোলকাতা চলে
সময় চলেছে রাজপথ ধরে
যশোর রোডেতে মানুষ মিছিল
সেপ্টেম্বর হায় একাত্তুর
গরুর গাড়ি কাদা রাস্তা পিছিল
লক্ষ মানুষ ভাত চেয়ে মরে
লক্ষ মানুষ শোকে ভেসে যায়
ঘরহীন ভাসে শত শত লোক
লক্ষ জননী পাগলের প্রায়
রিফুইজি ঘরে খিদে পাওয়া শিশু
পেটগুলো সব ফুলে ফেঁপে ওঠে
এইটুকু শিশু এতবড় চোখ
দিশেহারা মা কার কাছে ছোটে
সেপ্টেম্বর হায় একাত্তুর
এত এত শুধু মানুষের মুখ
যুদ্ধ মৃত্যু তবুও স্বপ্ন
ফসলের মাঠে ফেলে আসা সুখ
কার কাছে বলি ভাত রুটি কথা
কাকে বলি কর কর কর ত্রাণ
কাকে বলি ওগো মৃত্যু থামাও
মরে যাওয়া বুকে এনে দাও প্রাণ
কাঁদ কাঁদ তুমি মানুষের দল
তোমার শরীর ক্ষত দিয়ে ঢাকা
জননীর কোলে আধপেটা শিশু
এ কেমন বাঁচা? বেঁচে মরে থাকা
ছোট ছোট তুমি মানুষের দল
তোমার ঘরেও মৃত্যুর ছায়া
গুলিতে ছিন্ন দেহ-মন-মাটি
ঘর ছেড়েছ তো মাটি মিছে মায়া
সেপ্টেম্বর হায় একাত্তুর
ঘর ভেঙে গেছে যুদ্ধের ঝড়ে
যশোর রোডের দু’ধারে মানুষ
এত এত লোক শুধু কেন মরে
শত শত চোখ আকাশটা দেখে
শত শত শত শিশু মরে গেল
যশোর রোডের যুদ্ধ ক্ষেত্রে
ছেঁড়া সংসার সব এলোমেলো
কাদামাটি মাখা মানুষের দল
গাদাগাদি হয়ে আকাশটা দেখে
আকাশে বসত মরা ইশ্বর
নালিশ জানাবে ওরা বল কাকে
শত শত মুখ হায় একাত্তুর
যশোর রোড যে কত কথা বলে
এত মরা মুখ আধমরা পায়ে
পূর্ববাংলা কোলকাতা চলে।“
গিন্সবার্গের কবিতায় সে সময়কার যুদ্ধে বিধ্বস্ত বাংলাদেশের চিত্রটিই যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বাংলাদেশের পরম বন্ধু গিন্সবার্গ ৫ই এপ্রিল, ১৯৯৭ সালে নিউইয়র্কে পরলোকগমন করেন।
এলেন গিন্সবার্গএবং সেপ্টেম্বর অন যশোর রোডশা হ রি য়া র সো হে লএলেন গিন্সবার্গ একটি ইহুদী পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। তিনি নিউ জার্সির প্যাটারসন এলাকায় বেড়ে ওঠেন। ১৯৪৩ সালে তিনি ইস্টসাইড হাই স্কুল থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পরবতীর্তে মন্টক্লেয়ার কলেজে কিছুদিন অধ্যয়নের পর কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৪৫ সালে তিনি পড়ালেখার খরচ যোগাবার জন্য একটি চাকুরীতে যোগদান করেন। তিনি সে সময় কলম্বিয়া থেকে প্রকাশিত জেস্টার হিউমার ম্যাগাজিনে কিছুদিন কাজ করেন এবং ফিলোলেক্সান সোসাইটির সভাপতি নির্বাচিত হন।এলেন গিন্সবার্গ ভারতবর্ষে থাকাকালীন সর্বাধিক সময় কাটিয়েছিলেন কলকাতায়, ১৯৬২-১৯৬৩ সালে এবং তিকি পশ্চিমবাংলার কবিদের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন । তাঁর সঙ্গে হাংরি আন্দোলন এর কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও মলয় রায়চৌধুরীর হৃদ্যটা গড়ে ওঠে এবং তিনি আমেরিকায় ফিরে গিয়ে হাংরি আন্দোলন এর কবিদের রচনা সেখানকার প্রখ্যাত পত্রিকাগুকিতে প্রকাশের ব্যবস্হা করেছিলেন। এলেন গিন্সবার্গের বিখ্যাত কবিতা ‘হাউল’ এবং ‘ক্যাডিশ’ বাংলায় অনুবাদ করেছেন মলয় রায়চৌধুরী ।সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড - বিখ্যাত মার্কিন কবি এলেন গিন্সবার্গ রচিত একটি কবিতা যা থেকে পরে গান করা হয়েছিল। এলেন গিন্সবার্গ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ দিকে ভারতের কলকাতায় এসেছিলেন। কলকাতার বেশ কয়েকজন সাহিত্যিকের সাথে তার বন্ধুত্ব ছিল যার মধ্যে একজন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি সুনীলের বাড়িতেই উঠেছিলেন। তখন বাংলাদেশ থেকে অনেক শরণার্থী পশ্চিমবঙ্গ ও সীমান্তবর্তী অন্যান্য শহরে আশ্রয় নিয়েছিল। ব্রিটিশ রাজের সময় পূর্ব বাংলা ও পশ্চিমবঙ্গের সংযোগকারী সড়ক হিসেবে কাজ করতো “যশোর রোড”। অনেক বৃষ্টি হওয়ায় তখন যশোর রোড পানিতে ডুবে গিয়েছিল। সড়ক পথে না পেরে গিন্সবার্গ অবশেষে নৌকায় করে বনগাঁ পেরিয়ে বাংলাদেশের যশোর সীমান্তে পৌঁছেন। তার সাথে সুনীলও ছিলেন। তারা যশোর সীমান্ত ও এর আশপাশের শিবিরগুলোতে বসবাসকারী শরণার্থীদের দুর্দশা প্রত্যক্ষ করেন।এই অভিজ্ঞতা থেকেই গিন্সবার্গ এই কবিতাটি লিখেছিলেন। এই দীর্ঘ কবিতার সাথে সুর দিয়ে এটিকে গানে রূপ দিয়েছিলেন তিনি। আমেরিকায় ফিরে গিয়ে তার বন্ধু বব ডিলান ও অন্যান্য বিখ্যাত গায়কদের সহায়তায় এই গান গেয়ে কনসার্ট করেছিলেন। এভাবেই বাংলাদেশী শরণার্থীদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেন গিন্সবার্গ।এলেন গিনসবার্গ। একজন মার্কিন কবি, গীতিকার, আলোকচিত্রী এবং মঞ্চ অভিনেতা। তিনি ১৯২৬ সালে ৩ জুন নিউজার্সিতে জন্মগ্রহণ করেন। ‘ইবধঃএবহবৎধঃরড়হ৩’-এর একজন নেতৃস্থানীয় প্রচারক হিসেবেই তিনি সুপরিচিত।গিন্সবার্গ ছিলেন যুদ্ধবিরোধী। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মার্কিন সরকার যেখানে পাকিস্তানকে সমর্থন যুগিয়েছিল সেখানে এলেন গিন্সবার্গ বাংলাদেশের পক্ষে সরব ছিলেন। কোলকাতায় তার সাহিত্যিক বন্ধুদের সাথে নিয়ে তিনি যুদ্ধের ভয়াবহতা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার সংগ্রামে নেমেছিলেন।ওই বছরের সেপ্টেম্বরে রোলিং স্টোনের কিথ রিচার্ডস কিছু টাকা তুলে দিয়েছিলেন গিন্সবার্গের হাতে; পূর্ব বঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়েছে, হাজার হাজার বাঙালি শরণার্থী বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতের শরণার্থী শিবিরগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে, অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার তারা সেখানে— গিন্সবার্গের কাজ হবে সরেজমিন ঘুরে ওই যুদ্ধের প্রকৃত পরিস্থিতি তুলে ধরে প্রতিবেদন লেখা।কলকাতায় গিনসবার্গের সঙ্গী হয়েছিলেন তখন বিবিসি’র হয়ে রিপোর্ট করতে আসা গীতা মেহতা। কলকাতার কয়েকজন শিল্পী-সাহিত্যিকের সঙ্গে বন্ধুত্বের সূত্রে তিনি সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়িতে ওঠেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অন্যদেরসহ গিনসবার্গকে নিয়ে ঘুরে বেড়ান শরণার্থী শিবিরগুলোতে।তখন বাংলাদেশ থেকে অনেক শরণার্থী পশ্চিমবঙ্গ ও সীমান্তবর্তী অন্যান্য শহরে আশ্রয় নিয়েছিল। ব্রিটিশ রাজত্বের সময় পূর্ব বাংলা ও পশ্চিমবঙ্গের সংযোগকারী সড়ক হিসেবে কাজ করতো যশোর রোড।অনেক বৃষ্টি হওয়ায় তখন যশোর রোড পানিতে ডুবে গিয়েছিল। সড়ক পথে না পেরে গিন্সবার্গ অবশেষে নৌকায় করে বনগাঁ পেরিয়ে বাংলাদেশের যশোর সীমান্তে পৌঁছেন। তার সাথে সুনীলও ছিলেন। তারা যশোর সীমান্ত ও এর আশপাশের শিবিরগুলোতে বসবাসকারী শরণার্থীদের দুর্দশা প্রত্যক্ষ করেন।যশোর রোডের পাশে গড়ে ওঠা শরনার্থী শিবির এবং এপার থেকে ওপারে যাত্রা করা হাজার হাজার নীরিহ মানুষের নির্মম হাহাকারের প্রতিধ্বনি ফুটিয়ে তুলেছিলেন “সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড কবিতায়।”যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গিয়ে তার বন্ধু বব ডিলান ও অন্যদের সহায়তায় এই কবিতাটিকে তিনি গানে রূপ দিয়েছিলেন। কনসার্টে এই গান গেয়ে তারা বাংলাদেশী শরণার্থীদের সহায়তার জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন।‘দ্য ফল অব আমেরিকা’ বইয়ের সেরা কবিতাটি নিঃসন্দেহে ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। ১৯৮২ সালে ডাইরেক্টর বেন পসেট, আমস্টারডামের ঙহব ডড়ৎষফ চড়বঃৎু-তে স্টিভেনটেইলর এবং গিন্সবার্গকে প্রয়োজনীয় শিল্পী এবং রেকর্ডিং সুবিধা দেন। রেকর্ডিং-এরজন্য স্বরলিপি লিখেছেন স্টিভেন; সব আয়োজন শেষে গরষশু ডধু ঞযবধঃবৎ রেকর্ড করা হয় ঝঃৎরহম ছঁধৎঃবঃ - ঝবঢ়ঃবসনবৎ ড়হ ঔবংংড়ৎব জড়ধফ ১৯৮৩তে। শিল্পী ছিলেন গিন্সবার্গ নিজেই। এই কবিতার মাধ্যমেই তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি তাঁর একাত্মতা প্রকাশ করেন এবং আমেরিকায় ফিরে গিয়ে ১৯৭১ সালের ১লা আগস্ট নিউ ইয়র্কের মডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ‘পন্ডিত রবি শংকর’ ও জর্জ হ্যারিসন আয়োজিত কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’এ অংশগ্রহণ করেন। উল্লেখ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ আয়োজন করা হয়েছিল ৭১এর বাঙলাদেশী শরনার্থিদের সাহায্যার্থে।এই কনসার্টে জর্জ হ্যরিসন, বব ডিলান, জোয়ান বায়েজ সহ আমেরিকার আরও অনেক জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী-ই সঙ্গীত পরিবেশন করেন। পন্ডিত রবি শংকর ও অপর ভারতীয় কিংবদন্তী গায়ক আলি আকবর খানও গান পরিবেশন করেন এই কনসার্টে এবং এখান থেকে প্রায় আড়াই লাখ ডলার সংগৃহীত হয়।এই টাকার থেকেও বড়ো ব্যাপার ছিলো এই কনসার্ট সারাবিশ্বকে একটা নাড়া দিতে সক্ষম হয়েছিলো। সবার কাছে পৌঁছে গিয়েছিলো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতার কথা এবং আমাদের গৌরবান্বিত স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা। এর পর থেকে জনমত গড়তে থাকে এবং বিশ্ব অপেক্ষা করে বাঙলাদেশ নামের একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্মের জন্য।স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অর্থ সংগ্রহের জন্য “কনসার্ট ফর বাঙলাদেশ” ছাড়াও গিন্সবার্গ ওরাশিয়ার ইয়েভগেনি ইয়েভ তুসোস্কোর মিলে কবিতা পাঠের আসরও আয়োজন করেছিলেন।গিন্সবার্গের ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতাটি পরে ১৯৯৯সালে প্রয়াত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ তাঁর মুক্তির কথা চলচ্চিত্রে ব্যবহার করেন। প্রথমে খান মোহাম্মদ ফারাবীর অনুবাদ করা কবিতাটি গান হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন কিন্তু কবিতা থেকে গান করাটা অনেক কঠিন ছিলো তাই এটাকে গান করার দায়িত্বপড়ে তারেক মাসুদের বন্ধু প্রখ্যাত গায়িকা মৌসুমি ভৌমিকের উপর।তিনিই এই কবিতার ভাবানুবাদ করেন এবং সুরারোপ করেন। এই গানটি তারেক মাসুদ তাঁর অপর চলচ্চিত্র ‘মুক্তির গান’-এ ব্যবহার করার জন্য গিন্সবার্গের কাছ থেকে অনুমতি এনেছিলেন কিন্তু মুক্তির গান চলচ্চিত্রের ফাইনাল এডিটিং-এর সময় এই কবিতা বাদ দিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ঢুকানো হয়।বাংলা করে যে গানটি গাওয়া হয় তা হলো:
“শত শত চোখ আকাশটা দেখেশত শত শত মানুষের দলযশোর রোডের দুধারে বসতবাঁশের ছাউনি, কাদামাটি জল
কাদামাটি মাখা মানুষের দলগাদাগাদি হয়ে আকাশটা দেখেআকাশে বসত মরা ঈশ্বরনালিশ জানাবে ওরা বল কাকে
ঘরহীন ওরা ঘুম নেই চোখেযুদ্ধে ছিন্ন ঘর-বাড়ি-দেশমাথার ভিতরে বোমারু বিমানএই কালো রাত কবে হবে শেষ
শত শত মুখ হায় একাত্তুরযশোর রোড যে কত কথা বলেএত মরা মুখ আধমরা পায়েপূর্ববাংলা কোলকাতা চলে
সময় চলেছে রাজপথ ধরেযশোর রোডেতে মানুষ মিছিলসেপ্টেম্বর হায় একাত্তুরগরুর গাড়ি কাদা রাস্তা পিছিল
লক্ষ মানুষ ভাত চেয়ে মরেলক্ষ মানুষ শোকে ভেসে যায়ঘরহীন ভাসে শত শত লোকলক্ষ জননী পাগলের প্রায়
রিফুইজি ঘরে খিদে পাওয়া শিশুপেটগুলো সব ফুলে ফেঁপে ওঠেএইটুকু শিশু এতবড় চোখদিশেহারা মা কার কাছে ছোটে
সেপ্টেম্বর হায় একাত্তুরএত এত শুধু মানুষের মুখযুদ্ধ মৃত্যু তবুও স্বপ্নফসলের মাঠে ফেলে আসা সুখ
কার কাছে বলি ভাত রুটি কথাকাকে বলি কর কর কর ত্রাণকাকে বলি ওগো মৃত্যু থামাওমরে যাওয়া বুকে এনে দাও প্রাণ
কাঁদ কাঁদ তুমি মানুষের দলতোমার শরীর ক্ষত দিয়ে ঢাকাজননীর কোলে আধপেটা শিশুএ কেমন বাঁচা? বেঁচে মরে থাকা
ছোট ছোট তুমি মানুষের দলতোমার ঘরেও মৃত্যুর ছায়াগুলিতে ছিন্ন দেহ-মন-মাটিঘর ছেড়েছ তো মাটি মিছে মায়া
সেপ্টেম্বর হায় একাত্তুরঘর ভেঙে গেছে যুদ্ধের ঝড়েযশোর রোডের দু’ধারে মানুষএত এত লোক শুধু কেন মরে
শত শত চোখ আকাশটা দেখেশত শত শত শিশু মরে গেলযশোর রোডের যুদ্ধ ক্ষেত্রেছেঁড়া সংসার সব এলোমেলো
কাদামাটি মাখা মানুষের দলগাদাগাদি হয়ে আকাশটা দেখেআকাশে বসত মরা ইশ্বরনালিশ জানাবে ওরা বল কাকে
শত শত মুখ হায় একাত্তুরযশোর রোড যে কত কথা বলেএত মরা মুখ আধমরা পায়েপূর্ববাংলা কোলকাতা চলে।“
গিন্সবার্গের কবিতায় সে সময়কার যুদ্ধে বিধ্বস্ত বাংলাদেশের চিত্রটিই যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বাংলাদেশের পরম বন্ধু গিন্সবার্গ ৫ই এপ্রিল, ১৯৯৭ সালে নিউইয়র্কে পরলোকগমন করেন।