Thursday, May 10, 2018

স্মরণ ॥ সা’দত আলি আখন্দ

স্মরণ ॥ সা’দত আলি আখন্দ (১৮৯৯-১৯৭১)
আলী ফোরকান
জন্ম : ১৮৯৯ সালের ১ জুলাই
  মৃত্যু :  ১৯৭১ সালের ১২ মে
“... ইসলাম যে একটি ধর্ম, জাতি নয় এ কথা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে বাঙালী মুসলিমÑ তারা জাতিতে মুসলমান এ কথাটাই জোর গলায় প্রচার করেছেন। তারা ‘নেশান’ ও ‘রিলিজিয়ন’ এর একই অর্থ করে বসেছেন।” 
১৯২৮ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত মাসিক সাহিত্য পত্রিকা সওগাত-এ ‘বাঙালী’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখে বিদগ্ধ পাঠক সমাজে যিনি আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন তিনি হচ্ছেন মরহুম সা’দত আলি আখন্দ।
১৮৯৯ সালের ১ জুলাই বগুড়া শহরে প্রাচীন সংস্কৃতি কেন্দ্র মহাস্থানগড় লাগোয়া চিঙ্গাশপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে সা’দত আলি আখন্দের জন্ম। শিক্ষা জীবন শেষে ১৯২২ সালে তিনি পুলিশ বিভাগে যোগদান করেন। ব্রিটিশ পরবর্তী পাকিস্তান আমলেও সরকারের উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা হিসাবে চাকরি করলেও তাঁর একান্ত ইচ্ছা ছিল বাঙালীদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হবে। সেই রাষ্ট্রের গর্বিত পতাকাকে তিনি পরম শ্রদ্ধায় বুক উঁচু করে হাজারবার স্যালুট করবেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল অবহেলিত, নিগৃহীত বাঙালীর জন্য সুখী-সমৃদ্ধ ও স্বাধীন সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র হবে। যেখানে থাকবে না কোন হিংসা বিদ্বেষ, সকল বাঙালী ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে সকলে সৌহার্দপূর্ণ ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বসবাস করবে। তিনি তাঁর ক্ষুরধার লেখনী দিয়ে কুসংস্কারচ্ছন্ন সমাজকে সভ্য ও জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত করবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য তাঁর। বাংলাদেশ হানাদার ও দখলদার বাহিনী হাত থেকে মুক্ত হবার আগেই ১৯৭১ সালের ১২ মে বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি ইন্তেকাল করেন। 
ব্রিটিশ আমলে পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে দৈনন্দিন কঠিন দায়িত্ব শেষে যে সময়টুকু তিনি পেতেন, এই সময়টুকু সহকর্মীদের সঙ্গে আড্ডা না দিয়ে বাসায় ফিরে সাহিত্যসেবা এবং ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া এবং তাদের আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ব্যয় করতেন। সময়ের অভাবে প্রতিদিন রাত সাড়ে তিনটায় ঘুম থেকে উঠে সংগ্রহ করে আনা দুরূহ বই পড়তেন ও লেখালেখি করতেন। সমাজসচেতনমূলক প্রবন্ধ ও গ্রন্থ লিখে তৎকালীন পাঠক সমাজে তিনি লেখক ও সাহিত্যিক হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। ব্রিটিশ আমলের শেষের দিকে ব্রিটিশ সরকার সমগ্র ভারতের পুলিশ বাহিনীর জন্য ইংরেজি ভাষায় একটি রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। সেই প্রতিযোগিতায় তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে প্রায় ৫-৬ দিন দরজা বন্ধ করে প্রচুর মেধা ও পরিশ্রম করে লেখাটি সম্পন্ন করে দিল্লীতে পুলিশ হেড কোয়ার্টারে পাঠিয়েছিলেন। এই প্রতিযোগিতায় প্রায় দু’হাজার পুলিশ কর্মকর্তা অংশগ্রহণ করেছিলেন। প্রতিযোগিতার ফল প্রকাশের পর দেখা গেল তিনি প্রতিযোগিতায় ১ম স্থান অধিকার করে ‘ব্রিটিশ গোল্ড মেডেল’ ও রানী এলিজাবেথের প্রশংসাপত্র লাভ করেছেন।
সত্যিকার অর্থেই কবির পরিশ্রম, ধৈর্য ও ত্যাগ বৃথা যায়নি। তার বড় ও সেজো ছেলে যথাক্রমে জাতীয় অধ্যাপক ড. মুস্তাফা নূরউল ইসলাম ও প্রখ্যাত সাংবাদিক, কলামিস্ট, সাহিত্যিক, লেখক ও চরমপত্রখ্যাত এম, আর আখতার মুকুল তাদের নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে ও দেশের জন্য বিশেষ অবদান রাখায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাদেরকে দেশের সর্বোচ্চ সম্মানীয় পুরস্কার ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’-এ ভূষিত করেছে। পৃথিবীর ইতিহাসে আজ পর্যন্ত কোন দেশে একই পরিবারে দুই সহোদরকে সরকার দেশের সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত করেনি।
বাংলা সাহিত্যে বিশেষ অবদান রাখার জন্য বাংলা একাডেমি তার প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত গ্রন্থ, প্রবন্ধ, গল্প, কবিতাসমূহ সংগ্রহ করে ‘সা’দত আলি আখন্দ রচনাবলী’ নামে এক বিশাল গ্রন্থ ২০০৯ সালে প্রকাশ করে। এ ছাড়া বাংলা একাডেমি প্রতিবছর ১২ মে  তার মৃত্যুবার্ষিকীতে বাংলাদেশের একজন সৃজনশীল সাহিত্যিককে সা’দত আলি আখন্দ পদক, ক্রেস্ট ও প্রশংসাপত্র দিয়ে ভূষিত করে আসছে।
আমরা  তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা ও শ্রদ্ধাসহ স্মরণ করছি।

0 comments:

Post a Comment