স্মরণ : ছবি বিশ্বাস
আলী ফোরকান
জন্ম : ১৩ জুলাই ১৯০০
মৃত্যু: ১৯৬২ সালের ১১ জুন
ছবি বিশ্বাসের জন্ম ১৩ জুলাই ১৯০০। তিনি মঞ্চ এবং চলচ্চিত্রের একজন বিখ্যাত বাঙালি অভিনেতা। ছবি বিশ্বাস কলকাতানিবাসী ছিলেন। তার বাবা ভূপতিনাথ। ছবি বিশ্বাসের আসল নাম শচীন্দ্রনাথ। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে অন্নপূর্ণার মন্দির চলচ্চিত্রে প্রথম চিত্রাভিনয় করেন। তার অভিনীত চলচ্চত্রের মধ্যে সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় জলসাঘর, দেবী, কাঞ্চনজঙ্ঘা, তপন সিংহের পরিচালনায় কাবুলিওয়ালা (চলচ্চিত্র) এছাড়া প্রতিশ্রুতি, শুভদা, হেড মাস্টার উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও তিনি বহু বাণিজ্য সফল চলচ্চিত্রে পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেছেন। তিনি মূলত সাহেবী এবং রাশভারি ব্যক্তিত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয়ের জন্য খ্যাতিলাভ করেন। তিনি মঞ্চঅভিনয়েও বিখ্যাত ছিলেন। সমাজ, ধাত্রীপান্না, মীরকাশিম, দুইপুরুষ, বিজয়া প্রভৃতি নাটকে তার অভিনয় উল্লেখযোগ্য। তিনি প্রতিকার এবং যার যেথা ঘর ছবি দুটির পরিচালকও ছিলেন। তার অভিনীত ছবির মধ্যে রয়েছে- অন্নপূর্ণার মন্দির, চোখের বালি, চাণক্য, নিমাই সন্ন্যাসী, নর্তকী, প্রতিশ্রুতি, কর্ণার্জুন, এপার ওপার, সৌগন্ধ, পাষাণ দেবতা, মিলন, গরমিল, জীবন সঙ্গিনী, সমাধান, দ্বন্দ, দেবর, প্রতিকার, ছদ্মবেশী, মাটির ঘর, রাজলক্ষ্মী, পথ বেঁধে দিল, বন্দিতা, দুই পুরুষ, তুমি আর আমি, প্রেম কি দুনিয়া, মন্দির, বিরাজ বৌ, অভিযোগ, চন্দ্রশেখর, অনির্বাণ, বিদ্যাসাগর, দুর্গেশ নন্দিনী, লাখ টাকা, শেষের কবিতা, সদানন্দের মেলা, ওরা থাকে ওধারে, বিধিলিপি, সবার উপরে, দস্যু মোহন, সাহেব বিবি গোলাম ইত্যাদি।
ছবি বিশ্বাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি আদ্যোপান্ত নাগরিক, অর্থাৎ আরবান। পঞ্চাশের দশকে শহর কলকাতায় বিলিতি কেতাদুরস্ত বঙ্গীয় অভিজাতকুল কেমন ছিলেন, তার একটি নিখুঁত প্রতিচ্ছবি ছবি বিশ্বাস অভিনীত বিভিন্ন চরিত্র। স্যুট-টাই এবং ধুতি-পাঞ্জাবি, দু’টি বেশেই তিনি ঔপনিবেশিক বাংলার একটি চেহারাকে ধরে রেখেছেন। একই সঙ্গে একই শরীরে তিনি বহন করেছেন একটি বিলুপ্ত হয়ে আসা সময়ের দু’রকম ছবি। ছবি বিশ্বাসের পরিবার ছিল কলকাতার নিবাসী। যাত্রা ও থিয়েটারে বরাবরই উৎসাহ ছিল ছবি বিশ্বাসের। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় অ্যামেচার থিয়েটার করেছেন শিশির ভাদুড়ী, নরেশ মিত্রের মতো বড় বড় অভিনেতার সঙ্গে। ১৯৩৮ সাল থেকে তিনি পেশাদার হিসেবে নাট্যনিকেতনে যোগ দেন। অ্যামেচার নাটক দিয়ে জীবন শুরু করলেও পেশাদারি রঙ্গমঞ্চেও তিনি নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। ছবি বিশ্বাস ছিলেন সম্ভ্রান্ত জমিদার বংশের ছেলে। জমিদারি গেলেও তার মেজাজটা তাকে কোনো দিন ছেড়ে যায়নি। তিনি ছিলেন ‘লাস্ট অব দ্য অ্যারিস্টোক্রাটস’- তা কী অভিনয়ে, কী পারিবারিক চালচলনে। ছবি বিশ্বাস মূলত সাহেবি এবং রাশভারি ব্যক্তিত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয়ের জন্য খ্যাতিলাভ করেন। তিনি তার জীবদ্দশাতেই নিছকই এক চরিত্রাভিনেতা থেকে একটি বিশিষ্ট রূপকল্পে পরিণত হয়েছিলেন। যে কোনো চরিত্র রূপায়নে তিনি ছিলেন স্বাভাবিক অভিনয় প্রয়াসী অভিনেতা। ছবি বিশ্বাস বললেই একটি বিশেষ উচ্চতা, জলদগম্ভীর স্বর, একটি চাহনি, পদক্ষেপের বিশিষ্ট ধরন দর্শকের মানসপটে ভেসে ওঠে। ছবি বিশ্বাস একের পর এক ছবিতে কার্যত একই ধরনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। সব মিলিয়ে, বাঙালির কল্পনায় তিনি স্বয়ং একটি ‘টাইপ’! ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে ‘সঙ্গীত নাটক আকাদেমি’ তাকে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার সম্মান জানান। ১৯৬২ সালের ১১ জুন তিনি মোটরগাড়ি দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন।
0 comments:
Post a Comment