স্মরণ : শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন
আলী ফোরকান
জন্ম : ১৯১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর
মৃত্যু : ১৯৭৬ সালের ২৮ মে
শুধু অঙ্কন জগৎ নয়, শিল্প ও সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত কিংবা শুদ্ধ বুদ্ধিচর্চার কারো এই নামটির সঙ্গে পরিচয় নেই বাংলাদেশে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া বড় ভার। তিনি এমনই একজন মানুষ ছিলেন, যিনি চিত্রের ভাষায় তুলে ধরেছেন দেশ ও সমাজের অসঙ্গতি, বৈষম্য এবং সমসাময়িক বাস্তবতার নানা চিত্র। তার তুলির ছোঁয়ায় ছবিগুলো যেন হয়ে উঠত জীবন্ত। এক কথায় বলা যায়, তিনি ছিলেন অঙ্কন জগতের অপ্রতিদ্বন্দ্বী এক জাদুকর। তুলির আঁচড়ে তিনি লিখে গেছেন একের পর এক মানবতার গান। প্রকৃতি ও মানবদরদী এই মানুষটি ১৯১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৩৮ সালে আর্ট কলেজ থেকে শিল্পকলা বিষয়ে শিক্ষা লাভ করে সেখানেই শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৪৮ সালে তিনি সরকারি আর্ট ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলা ১৩৪৯ সনের দুর্ভিক্ষের সময় রাস্তায় পড়ে থাকা ছিন্নমূল মানুষের ছবি ও স্কেচে জয়নুলের ক্যানভাস মর্মস্পর্শী হয়ে ওঠে। শিল্পীর খ্যাতি ও সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৭০ সালে জয়নুল আবেদিন ‘নবান্ন’ নামে এক দীর্ঘ ছবি এঁকেছিলেন। সেই ছবি যেন গ্রামবাংলার চিরায়ত জীবনের প্রতিচ্ছবি। ১৯৭০ সালে বাংলাদেশে ঘটে যায় ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস। প্রকৃতির সেই ধ্বংসলীলা নিয়ে ছবি এঁকেছিলেন-‘মনপুরা ৭০।’ তার আঁকা ছবিগুলো শুধু ছবিই নয়; বরং ইতিহাসের এক একটি স্মরণীয় অধ্যায়কে তুলির আঁচড়ে আটকে রেখেছে।
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংগৃহীত তার শিল্পকর্মের সংখ্যা ৮০৭। বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের সংগ্রহে প্রায় পাঁচ শত, তার পরিবারের কাছে এখনো চার শতাধিক চিত্রকর্ম, ময়মনসিংহের সংগ্রহশালায় ৬২ চিত্রকর্ম ছাড়াও পাকিস্তানের বিভিন্ন সংগ্রহশালায় তার বিপুল পরিমাণ চিত্রকর্ম সংরক্ষিত রয়েছে।
পূর্ব বঙ্গে তথা বাংলাদেশে চিত্রশিল্প বিষয়ক শিক্ষার প্রসারে আমৃত্যু প্রচেষ্টার জন্য জনসাধারণ্যে তিনি শিল্পাচার্য অভিধা লাভ করেন। বাংলাদেশের চিত্রকরদের মধ্যে তিনি শিল্পগুরু বিবেচিত। তার নামে চারুকলা বিভাগে একটি গ্যালারি রয়েছে। ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের ৩৫ সংখ্যক গ্যালারিটি শিল্পচার্য জয়নুল আবেদিন চিত্রশালা হিসেবে সজ্জিত করে। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন কর্তৃক ৯ জুলাই, ২০০৯ বুধ গ্রহের একটি জ্বালামুখ মানবসভ্যতায় মানবিক মূল্যবোধ ও উপলব্ধিকে গভীরতর করার প্রেক্ষিতে আবেদিন জ্বালামুখ নামে নামকরণ করা হয়। তার জন্মদিন উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে উৎসব হয় ও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালায় (আর্ট গ্যালারি) শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।
জয়নুল আবেদিন ছবি আঁকা নিয়েই ব্যস্ত থাকেননি। শুদ্ধ ও সুস্থ শিল্পচর্চাকে অব্যাহত রাখতে তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৭৫ সালে শিল্পকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়া শিল্পীর জš§স্থান জেলা শহর ময়মনসিংহের সাহেব কোয়ার্টার এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে তার কালজয়ী চিত্রকর্ম ও আনুষঙ্গিক বেশকিছু ব্যবহার্য জিনিসপত্র নিয়ে গড়ে উঠেছে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা। শিল্পাচার্যের চিরচেনা ও ভালো লাগার এ স্থানটিতে তিনি নিজ উদ্যোগে ও জেলা প্রশাসনের সহায়তায় তার আঁকা ৭০টি চিত্রকর্ম নিয়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ এপ্রিল প্রতিষ্ঠা করেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা। সংগ্রহশালাটি উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। ১৯৮৭ সালে সংগ্রহশালাটি দ্বিতল ভবনে উন্নীত করা হয় এবং নিচ তলায় রক্ষিত চিত্রকর্মগুলোকে দ্বিতীয় তলায় স্থানান্তর করে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ১৯৭৬ সালের ২৮ মে মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকা আর্ট কলেজ প্রাঙ্গণে তাকে সমাহিত করা হয়।
0 comments:
Post a Comment