Monday, February 12, 2018

মৎস্য চাষে সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব

মৎস্য চাষে সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব
আলী ফোরকান 
কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত এ দেশের জাতীয় আয় বৃদ্ধি ,কর্মসংস্থান ,দারিদ্র বিমোচন এবং পুষ্টি চাহিদা পূরনে ক্রমবর্ধমান হারে অনন্য অবদান রেখে চলেছে মৎস্য খাত। মৎস্য খাতের এ ধারা অব্যাহত রাখার পক্ষে আভ্যন্তরীণ বদ্ধ জলাশয় থেকে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য মৎস্য অধিদপ্তর কতিপয় বাস্তবমূখী পদক্ষে গ্রহন করেছে। এমন একটি পদক্ষেপের সফল উদাহরন ময়মনসিংহ মৎস্য চাষ সম্প্রসারন প্রকল্প। ১৯৯০ সালের জুলাই মাস থেকে ময়মনসিংহ জেলার ৬ টি থানার একটি পাইলট প্রকল্প হিসাবে এর যাত্রা শুরু হয়। প্রাথামিক পর্যায়ে এ প্রকল্পের মূল লক্ষ্য ছিল- উন্নত মৎস্য চাষ পদ্ধতি সম্প্রসারনের 
মাধ্যমে লক্ষ্য জনগোষ্ঠী (ভূমিহীন ও প্রান্তিক চাষী) –এর
১. আত্মকর্মসংস্থান
২. পুঁজি সংগঠন এবং
৩. দারিদ্র বিমোচন
এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য নিন্মলিখিত কার্যক্রম গ্রহন করা হয়ঃ-
(ক) প্রদর্শনী পুকুর স্থাপনের মাধ্যমে মৎস্য চাষে উদ্বুদ্ধকরন ঃ প্রকল্পের শরুতেই সংশ্লিষ্ট এলাকার জনসাধারনকে উন্নত মাছ চাষের কালকৌশল হাতে কলমে শেখানো ও উৎসাহিত করনের লক্ষ্যে নির্বাচিত পুকুরে প্রদর্শনী মৎস্য চাষ কার্যক্রম শুরু করা হয়। ১ম ধাপে ৪৩ হেক্টর জলায়তনে ৫১১ টি প্রদর্শনী পুকুর পরিচালিত হয় যার মাধ্যমে ১১৬ মেট্টিক টন মাছ উৎপাদন সম্বব হয়। ১৯৯৩-১৯৯৪ সালে আরও ৫.৯ হেঃ এলাকায় ১২৮টি পুকুরে  এ জাতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়। এ প্রদর্শনী মৎস্য চাষ কার্যক্রম এলাকার জনসাধানের মাঝে ব্যাপক সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়। 
(খ) ঋণকার্যক্রমঃ প্রকল্প শুরু থেকেই ভূমীহীন এবং প্রান্তিক চাষীদের মৎস্য চাষ অংশগ্রহনের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রযুক্তিগত সহায়তায় পাশাপাশি বিনা বন্ধকী ঋণপ্রদান কার্যক্রম চালু করা হয়।
কার্প জাতীয় মাছের মিশ্র চাষ ও নার্সারী স্থাপনের জন্য ১ম ধাপে ৮২৩ জন  চাষীর মাঝে ৮৫.৮৫ লক্ষ্য টাকা ঋণ বিতরন করা হয়। এর মাঝে শতকরা ভাগ ছিলেন মহিলা চাষী। ১-৩ বৎসর মেয়াদী এ ঋণের প্রায় শতকরা ৯৯ ভাগ আদায় করা সম্বব । 
পরবর্তী পর্যায়ে ( দ্বিতীয ধাপের শুরুতে ) প্রকল্প থেকে ঋণ বিতরণের পাশাপাশি বানিজ্যিক ব্যাংকসমুহকে সম্পৃক্ত করে এ কার্যক্রম জোরদার করার উদ্যেগ নেয়া হলেও কৌশলগত কারনে এনজিওদের সম্পৃক্ততার বিষয় বিবেচনার আনা হয়। 
(গ) সংযোগ চাষী কার্যক্রম ঃ প্রকল্প এলাকার ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে যাতে উন্নত মৎস্য চাষ প্রযুক্তি গ্রহন ও বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয় সেজন্য প্রদর্শনী ও ঋণদান কার্যক্রমের পাশাপাশি সংযোগ মৎস্য নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের প্রশিক্ষন ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করে মৎস্য চাষ সম্প্রসারন কার্যক্রম জোরদাদর করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়। ১ম ধাপ ও ২য় পর্যায়ের ১ম দিকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত এ কার্যক্রমে মোট ২৫৯৪ জন চাষী অন্তর্ভূক্ত হন। এ সকল চাষীরি পুকুরের মোট আয়তন ২৯৭ হেঃ এবং উৎপাদন ১০৬৫ মেট্রিক টন মাছ।
(ঘ) প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ঃ প্রকল্পের আওতাভুক্ত সকল পর্যায়ের মাছ চাষীদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। পাশাপাশি প্রকল্প এলাকায় কর্মরত সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা/কর্মচারী ও সম্প্রসারণ কর্মীদের যুগোপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। প্রকল্পের প্রথম ধাপের অভূতপূর্ব সাফল্যে দাতা সংস্থা ডানিডা প্রকল্পকে দ্বিতীয় ধাপ পর্যন্ত সমপ্রসারণের সুপারিশ করে। সরকার ও দাতা সংস্থার সমঝোতার প্রেক্ষিতে ১৯৯৩ সালের জুলাই মাস থেকে নতুন করে বৃহত্তর মনমনসিংহ  এবং গাজীপুর তথা ৭টি জেলার ২৬টি থানায় প্রকল্প কার্যক্রমের ২য় পর্যায় বাস্তবায়ন শুরু হয়। এপ্রিল ১৯৯৯  সালে দাখিলকৃত প্রজেক্ট ডকুমেন্টে বিবৃত প্রপ্রোজল রিপোর্ট অনুযায়ী ২য় ধাপের ১ম বছর প্রকল্প থেকে লক্ষ্য জনগোষ্ঠী তথা ভূমিহীন ও প্রান্তিক মৎস্য চাষীদের সরকারি ঋণ প্রদানের প্রস্তাব রাখা হয়। ২য় বছর থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং উপযুক্ত এন,জি, ও কে এ কাজে সম্পৃক্ত করতে পরামর্শ দেয়া হয়।
প্রদর্শনী ও ঋণ প্রদান কার্যক্রম: প্রথম ধাপের মত অব্যাহত রাখার পাশাপাশি প্রশিক্ষণ কার্যক্রম আরও শক্তিশালী করার জন্য ২য় ধাপে থানা পর্যায়ে প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা নিয়োজিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
১৯৯৩ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত এন,জিও দের অংশ গ্রহণ ব্যতিরেকেই প্রকল্প কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হয়। নানা কারণে এ সময়ের মাঝে এন,জিও সম্পৃক্ত করা সম্ভব হয়নি। এরই মাঝে মধ্যবর্তী মূল্যায়ন (যা ১৯৯৬ সালে দাতা সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত হয়) রিাের্ট অনুযায়ী  বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ, দাতা সংস্থা এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সমূহের গোলটেবিল বৈঠকের আলোচনা ও সমঝোতা অনুযায়ী ৩-৫-৯৮ তারিখ থেকে ত্রিপাক্ষিক অংশ গ্রহনের মাধ্যমে এ প্রকল্পের নতুন পদযাত্রা শুরু হয়েছে। এদিন এন,জিও দাতা সংস্থা (ডানিডা) এবং সরকারের মনোনীত প্রতিনিধির মাঝে সমঝোতা স্মারক (এম.ও.ইউ) স্বাক্ষরিত হয়েছে।
নব আঙ্গিকে দ্বিতীয় ধাপ: প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে ভৌত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ঝ ২৫০০০ পুকুরে গড় পড়তা ২.৫ টন/হেক্টর মাছ উৎপাদন করা হবে। ইতিমধ্যে ২০,০০০ পুকুরে ঋণ প্রদান/প্রযুক্তি সম্প্রসারণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে। অবশিস্ট ৫০০০ পুকুরে উন্নত মৎস্য চাষ প্রযুক্তি সম্প্রসারণের লক্ষ্যে এ,জি,ওদের ঋণ প্রদানের দায়িত্ব হস্তান্তর করা হয়েছে। ত্রিপাক্ষিক অংশগ্রহনের মাধ্যমে প্রকল্পের কাজে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে।
বর্তমানে বাস্তবায়নাধীন কার্যাবলীর কতিপয় কৌশল নিুে বর্ণিত হলো ঃ
* উন্নত মৎস্য চাষ প্রযুক্তি সম্প্রসারণে এক কেন্দ্রিক লক্ষ্যমাত্রার  পরিবের্ত দলী লক্ষ্যমাত্রার  কাজ করা।
* ঋণ কার্যক্রমের ক্ষেত্রে মৎস্য চাষী দল গঠনের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ঋণ সহায়তা প্রদান করা।
প্রযুক্তি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে অংশ গ্রহণমূলক কর্ম সম্পাদন ও শিখুন  পদ্ধতি বাস্তবায়ন করা।
ক্স কম ব্যয়  করে মাছ উৎাদন করার পদক্ষেপ গ্রহণ সম্ভাব্য উৎপাদন উপকরণ চাষীর নিজ উদ্যোগে আহরণ ও বিনিয়োগ করা। (গোবর, ক্ষেত্র বিশেষ কুড়া ইত্যাদি)।
ক্স সহজ শর্তে এনজিওদের মাধ্যমে ঋনদান কর্মসূচি।
ক্স পুনপৌনিকমাছ ধরা এবং পুনঃ মজুদ কৌশল অবলম্বন।
ক্স নিম্ন পর্যায় থেকে মৎস্য চাষীদল এর মাধ্যমে প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরী ও বাস্তবায়ন।
ক্স ১০-১৫ জন সদস্যদের যে মৎস্য চাষীদল গঠিত হবে সেখানে খাবার মাছ উৎপাদনকারী মৎস্য চাষী,নার্সারী পরিচালনাকারী ,পোনা ব্যবসায়ী মাছ ধরা ও বাজারজাতকারী উপকরন প্রস্তুুতকারী ( যেমন জাল নির্মাতাকারী) প্রভূতি মাছ চাষ ও ব্যবস্থাপনার বহুমুখী কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গকে একত্রিত করা । 
ক্স চাষীদল এর নির্বাহী কমিটি গঠন করে স্থানীয় সিদ্ধান্ত গ্রহনক্ষম নেতৃত্ব গড়ে তোলা। 
ক্স সকল পর্যায়ে মহিলাদের অংশগ্রহনের সুযোগসৃষ্টি ও ক্ষমতায়নের উপযোগী পরিবেশ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা। 
ক্স প্রকল্প মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ও (অনুন্য৫ বছর) প্রচলিত কার্যক্রম পরিচালনার এনজিও ডি ও এফ() সহযোগিতা অব্যাহত রাখা। এছাড়াও প্রকল্প ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কতিপয় নতুন ও অভিনব ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে এর মাঝে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলোঃ-
ক্স কেন্দ্রীয় প্রকল্প ব্যবস্থাপনা এর ক্ষেত্রে সরকার ও দাতা সংস্থার অংশীদারীত্বের পাশাপাশি সহযোগী এনজিও দের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে। 
ক্স দল গঠনে ও প্রেরনা সৃষ্টি প্রশিক্ষন,সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিপ্রযুক্তি হস্তান্তর ও ঋণকর্মসুচী বাস্তবায়ন –প্রতিটি ক্ষেত্রে ডিওএফ, ডিটিএ,এবং এনজিওদের ও সরাসরি অংশগ্রহনের ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা হয়েছে।
ক্স প্রকল্পভূক্ত কর্মকর্তাদের থেকে প্রশিক্ষন কর্মকর্তা ও থানা মহিলা উন্নয়নকারী এবং তদনিন্মপদস্থ কর্মচারীগনকে সংশ্লিষ্ঠ এনজিও দের নিকট ন্যান্ত করা হয়েছে। –প্রকল্প মেয়াদে এদের যাবতীয় ব্যয় ( বেতন ভাতাদি ) ডিটি এ বহন করবে । এটা করা হয়েছে ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ জনবলকে এনজিওদের সহায়তাদানে নিযুক্ত করার জন্য। যাতে প্রকল্পের সুচারুরুপে সম্পন্ন করা যায়। 
ক্স কেন্দ্রিয় ব্যবস্থপনার পাশাপাশি জেলা ও থানা পর্যায়ে ও ত্রিপাক্ষিক ব্যবস্থাপনার প্রাতিষ্টানিক কাঠামো তৈরি করা সম্বব হয়েছে। এনজিওদের ভৌত সুবিধাদি অফিসও সম্প্রসারন সরঞ্জামাদি যানবাহন ইত্যাদি প্রকল্প মেয়াদ কালীন সময় ব্যবহারের জন্য প্রকল্প কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সরবরাহ করা হয়েছে । 
আশা করা যায় নতুন পর্যায়ে প্রকল্পের এ পদযাত্রার মাধ্যমে আমরবর্ধনমুলক কর্মকান্ডে পুরুষের পাশাপাশি মহিলাদের অংশগ্রহনের সুযোগ সৃষ্টিকরে একটি সফল লাভজনক কর্মসূচি কাঙ্খিত লক্ষ্যে পেীঁছাতে সক্ষম হবে। একই কৌশল অবলম্ব করে পটুয়াখালী বরগুনা মৎস্য চাষ সম্প্রসারন প্রকল্প এবং বৃহত্তর নোয়াখালী জেলায় মৎস্য চাষ সম্প্রসারন প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে । 
অভ্যন্তরীন উন্মক্ত জলাশয়ে মৎস্য উৎপাদনের ক্রমহ্রাসমান প্রবনতার মোকাবেলা ময়মনসিংহ মৎস্যচাষ সম্প্রসারন প্রকল্প একটি সাহসী ও বাস্তবমূখী কর্মপ্রয়াস হিসেবে ইতিমধ্যে চিহ্নিত হয়েছে।
আমাদের প্রত্যাশা: প্রকল্পের লক্ষ্যে জনগোষ্ঠীর তথা ভূমীহীন ও প্রান্তিক চাষীগণ মহিলা ও পুরুষ উন্নত মৎস্য চাষ পদ্ধতি অনুসরন করে আয়বর্ধনমূলক কর্মকান্ডে সরাসরি অংশগ্রহন করে স্ব-কর্মসংস্থানে সক্ষম হবেন যার ফলশ্র“তিতে তাদের আর্থসামাজিক অবস্থান ও ভৌত অবস্থার উন্নয়ন হবে। থানা পর্যায়ে মৎস্য চাষ উন্নয়ন ও সম্প্রসারন বর্তমান ক্ষমতা আবো বাড়বে এবং প্রকল্প এলাকার বদ্ধ জলাশয় উন্নত মৎস্য চাষ প্রযুক্তি প্রযোগের ফলে মৎষ্য উৎপাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে । এনজিওদের মাধ্যমে পুকুর পরিচালনাকারীগন মৎস্য উৎপাদন জন্য সহজ শর্তে ঋণ সহায়তা প্রাপ্তির বিষয়ে নিশ্চয়তা লাভ করবেন। 

0 comments:

Post a Comment