খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, বিবেচ্য বিষয়াবলী
আলী ফোরকান
বিশ্বব্যাপী খাদ্যের মূল্য অস্বাভাবিকহারে বেড়ে চলেছে। ফাও (ঋঅঙ)-এর মতে বিশ্ব বাজারে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে নিু আয়ের দেশসমূহের আমদানি ব্যয় বেড়েছে ২ হাজার ৭৮০ কোটি মার্কিন ডলার। জলবায়ুগত পরিবর্তনের ফলে বিশ্বের অনেক দেশেই বৈরী আবহাওয়ায় ফসল উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। পাকিস্তান, চীন, জাপান ও কানাডায় প্রবল বন্যায় যেমন ফসলের ক্ষতি হয়েছে সেই সঙ্গে বিশ্ব খাদ্য বাজারে পড়েছে এর বাড়তি চাপ। খরার কারণে রাশিয়ায় গমের উৎপাদন কমে গেছে যার পরিমাণ মোট চাহিদার এক-পঞ্চমাংশ। সে কারণে দেশটি ইতিমধ্যে খাদ্যদ্রব্য রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। মোজাম্বিকে খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধিতে দাঙ্গা শুরু হয়েছে। পশ্চিম আফ্রিকার দেশ নাইজারে ভয়াবহ খরার কারণে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে এবং সেখানকার মানুষ গাছের পাতা, সাপ, ব্যাঙ এমনকি টিকটিকি খেয়ে বাঁচার চেষ্টা করছে। দেশটির কয়েক লাখ শিশু মৃত্যু ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (আইএফপিআরআই) প্রতিবেদনে বলা হয় বিশ্বের প্রায় ১০০ কোটি মানুষ ক্ষুধাপীড়িত রয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী ২৫টি দেশে ক্ষুধা পরিস্থিতি উদ্বেগজনক পর্যায়ে যার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। কংগোতে খাদ্য উৎপাদন কমে যাওয়ায় সে দেশে খাবারের সরবরাহ ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বৈরী আবহাওয়ায় একদিকে যেমন খাদ্য উৎপাদন কমে যাচ্ছে সেই সঙ্গে খাদ্যমূল্যের বৃদ্ধির কারণে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী খাদ্যমূল্যের অস্থিরতার এই সময়ে ১৬ কোটি মানুষের বাস বাংলাদেশের অবস্থা কেমন? ইতিমধ্যে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে চাল ও গমের দাম যথাক্রমে ৬ দশমিক ৪৫ শতাংশ ও ১৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ বেড়েছে। ২০০৮ সালে যখন বিশ্ববাজারে খাদ্যশস্যের দাম অস্বাভাবিকহারে বেড়ে গিয়েছিল বাংলাদেশেও তার প্রভাব পড়েছিল। তথ্যমতে দেশের দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী বেশিরভাগ মানুষের দৈনিক আয়ের ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ ব্যয় হয় চাল কেনায়। সবমিলিয়ে দারিদ্র সীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে প্রায় ২ কোটি মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বসবাস করছে। দেশে সরকারের কাছে খাদ্য মজুদ আছে ৬ লাখ ৫০ হাজার টন যা ১৬ কোটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য খুবই সামান্য। জলবায়ুগত পরিবর্তনের প্রভাব বাংলাদেশেও শুরু হয়েছে। সময়-অসময়ে বন্যা, খরা ও অন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেশের ফসল উৎপাদনকে ব্যাহত করছে।
গত বোরো মৌসুমে অসময়ে আগাম বন্যায় হাওর এলাকার বিস্তীর্ণ ধানের জমি তলিয়ে যায় যা দেশের বোরো উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। চলতি আমন মৌসুমের শুরুতে খরা চলতে থাকায় দেশের বিভিন্ন এলাকার বোনা আমনের ব্যাপক ক্ষতি হয়। সেচ দিয়ে কৃষককে রোপা আমনের চারা রোপণ করতে হয় যা আবার অমৌসুমে বা দেরিতে বন্যার পানি আসায় পানির নিচে চলে যায়। এবার আমন থেকে লক্ষ্য অনুযায়ী ধানের উৎপাদন পাওয়া দুরূহ হয়ে পড়বে। সব মিলিয়ে বলা যায় জনবহুল দেশের খাদ্য নিরাপত্তা অত্যন্ত নাজুক অবস্থার মধ্যে রয়েছে। সরকার চলতি বাজেটে ১১ লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানির জন্য অর্থ বরাদ্দ রেখেছে কিন্তু এতেই কি দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা বিধান করা সম্ভব? বিশ্ব খাদ্য উৎপাদন পরিস্থিতি সেই সঙ্গে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিÑ এ দুটোকে বিবেচনায় এনে পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবেলা করে দেশের মাটিতেই নিজেদের চাহিদা মোতাবেক খাদ্য উৎপাদন করার প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেয়া দরকার এখনই। মোটকথা দেশের উৎপাদন বাড়াতে না পারলে যেমন ১১ লাখ টন চাল বাইরে থেকে আনলেই চাহিদা পূরণ হবে না সেই সঙ্গে বিশ্ববাজারে টাকা দিয়েও যে সময়মতো চাহিদা অনুযায়ী চাল পাওয়া যাবে তার কোনো নিশ্চয়তাই নেই যার অভিজ্ঞতা হয়েছে ভারত থেকে চাল পাওয়ার ক্ষেত্রে। এখন প্রশ্ন হলো দেশে বিশেষ করে ধানের উৎপাদন বাড়ানোর কতোটা সম্ভাবনা রয়েছে। খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ মোটেই পিছিয়ে নেই এটা নির্দ্বিধায় বলা যায় কারণ বাংলাদেশ এখনো বিশ্বের চতুর্থ ধান উৎপাদনকারী দেশ। কৃষিবান্ধব বর্তমান সরকার ২০১৩ সালের মধ্যে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে প্রতিশ্র“তিবদ্ধ যা বাস্তবায়ন করা মোটেই অসম্ভব নয়। তবে এর জন্য দরকার সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ গ্রহণের। দেশের বর্তমান প্রচলিত ধান উৎপাদন পদ্ধতি এখনো আধুনিক প্রযুক্তি মোতাবেক তথা বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থাপনায় হয় না। বোরো চাষকে সঠিক ব্যবস্থাপনার আওতায় এনে ধানের উৎপাদন বর্তমানের চেয়ে ৫০ থেকে ৬০ ভাগ পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব যার জন্য করণীয় ঃ
১. জলাবদ্ধতার কারণে হাকালুকির মতো হাওর অঞ্চলের বিশাল এলাকা এখনো বোরো চাষের আওতায় আনা যায়নি যা সঠিক পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থার মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ জমি বোরো চাষের আওতায় চলে আসতে পারে। অন্যদিকে পানি সেচ ব্যবস্থার অভাবে ময়মনসিংহ অঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিপুল পরিমাণ জমি শুধুমাত্র বৃষ্টিনির্ভর আমন চাষের আওতায় রয়েছে যেখানে তাৎক্ষণিক সেচের ব্যবস্থা করে বোরো চাষের এলাকা বাড়ানো সম্ভব।
২. বোরো মৌসুমে কৃষকের জমিতে সুষম সারের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। দেশের প্রান্তিক ধানচাষীরা তাদের সামর্থ্য না থাকায় বোরো চাষে বিশেষ করে পিএসপি, পটাশ, জিপসাম সঠিক পরিমাণে প্রয়োগ করে না। অনেক ক্ষেত্রেই ইউরিয়া সার প্রয়োজনের তুলনায় বেশি প্রয়োগ করে। দেশের মোট ধানের উৎপাদন বাড়ানোর চিন্তাকে মাথায় রেখে কৃষকের মাঝে প্রয়োজনীয় সার উপকরণ ঋণ হিসেবে সরবরাহ করে জমির মোট উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
৩. পরিবর্তিত জলবায়ুর সঙ্গে খাপ খাইয়ে উন্নত ধানের জাত উদ্ভাবন অত্যন্ত জরুরি। এক্ষেত্রে গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে যথাযথ সহযোগিতা দেয়া দরকার। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় উপকূলীয় এলাকার জমি লবণাক্ত হয়ে যাচ্ছে। উপকূলীয় এলাকার জন্য লবণাক্ততা সহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবন ও তা মাঠ পর্যায়ে দ্রুত ছড়িয়ে দেয়া দরকার।
৪. দেশে হাইব্রিড ধানের চাষ আরো সম্প্রসারণ করার উদ্যোগ নিতে হবে। ভারতে হাইব্রিড ধানের চাষ সম্প্রসারণ করার জন্য সরকার একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে। চীনে সরকারের নেয়া কর্মসূচির বদৌলতে দেশটির ৬০ ভাগ ধানের জমি হাইব্রিড ধান চাষের আওতায় এসেছে। বর্তমানে আমাদের দেশের প্রায় ৬ থেকে ৭ শতাংশ জমিতে হাইব্রিড ধানের চাষ সম্প্রসারিত হয়েছে যা কমপক্ষে ২৫ ভাগ এলাকায় সম্প্রসারিত হওয়া দরকার। সরকারকে এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
৫. সময়মতো বোরো মৌসুমে সেচ শুরু করতে হবে। সেচ মালিকেরা তেল বা বিদ্যুৎ বিল সাশ্রয়ের জন্য সময়মতো মেশিন চালু করে না এবং অনেক ক্ষেত্রেই ১৫ থেকে ৩০ দিন পর্যন্ত দেরি করে। এতে একদিকে যেমন কৃষকের বীজতলার চারার বয়স বেড়ে যায় অন্যদিকে ফসল আগাম বন্যার ঝুঁকিতে থেকে যায়। দেরিতে মেশিন চালু করার ফলে ধানের ফলন স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যায় ফলে কৃষকের জন্য ধান উৎপাদন লাভজনক হয় না। পক্ষান্তরে মেশিন মালিকেরা ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ ফসল নিয়ে নেয় এবং তাতে তাদের পুষিয়ে যায়। সারা দেশে যাতে মৌসুম শুরুর সঙ্গে সঙ্গে মেশিন মাঠে চালু করা হয় তার জন্য সরকার থেকে নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেয়া দরকার। এতে করে কৃষক সময় মতো কম বয়সের চারা জমিতে রোপণ করতে পারবে, জমিতে বেশি সময় থাকার ফলে গাছের বাড় বাড়তি ভালো হবে যা বেশি ফলন দিতে সহায়ক হবে অন্যদিকে ফসল সময়মতো ঘরে তোলা যাবে।
দেশে ধান বা চালের দাম বাড়ার ফলে দিনমজুর শ্রেণীর মানুষের অসুবিধা হচ্ছে পক্ষান্তরে ধান উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত প্রায় ২ কোটি কৃষি পরিবার ধানের ভালো দাম পাওয়ায় খুশি। এ কথা সত্য যে, প্রতি বছরই ধান চাষের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে তাই উৎপাদক শ্রেণী ধানের উপযুক্ত দাম পাবে এটাই আমরা প্রত্যাশা করি। এখন প্রয়োজন উৎপাদন বাড়ানোর। প্রাকৃতিক দুর্যোগের এই দেশে ১৯৭৬ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ১৪টি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে। ১৯৫৩ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত মোট ৫২ বার বন্যা হয়েছে। এর মধ্য দিয়েই ১৯৬১ সালের তুলনায় ধানের উৎপাদন তিনগুণ বাড়ানো সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশে এখনো যে প্রযুক্তি রয়েছে এবং চাষের আওতায় যে জমি আছে তার যথাযথ ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দেশের চাহিদা অনুযায়ী খাদ্যশস্য উৎপাদন করা কোনোক্রমেই অসম্ভব নয়। তাই আমরা আশা করবো সরকারের যথাযথ সিদ্ধান্ত নেয়া ও তার বাস্তবায়নের মাধ্যমে আগামী দিনে দেশে ধানের উৎপাদন বেড়ে যাবে, জনবহুল এই দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তাকে জোরদার করবে।
0 comments:
Post a Comment